জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আপোষকামিতা ঢুকে গেছে: সুলতানা কামাল

সামরিক-বেসামরিক, আমলাতন্ত্র ও আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর প্রভাবশালী পর্যায়ে জঙ্গিবাদের সমর্থক রয়েছে বলে মন্তব‌্য করেছেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2016, 11:58 AM
Updated : 27 August 2016, 12:17 PM

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে রন্ধ্রে, রন্ধ্রে বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গিবাদ সমর্থক কিংবা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত আছে, সেই মানুষগুলো বসে আছে।”

শনিবার বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় যুব কনভেনশনে সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের আমলাতন্ত্রে আছে, সামরিক বাহিনীতে আছে, আমাদের আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীতে আছে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আছে। অন্যান্য সমস্ত কিছু যারা নিয়ন্ত্রণ করে সব জায়গাতে আছে। অত্যন্ত প্রভাবশালী, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসে আছে। এটা যদি আমরা না বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে আমাদের লড়াইয়ের কৌশলে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে বাধ‌্য হব।”

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সুলতানা কামাল বলেন, “যারা ৭৫ এর বেনিফিশিয়ারি তারা সবাই ছিল পাকিস্তানের মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষিত। জঙ্গিবাদের অত্যন্ত প্রকট, উৎকট, নৃশংস রূপ আমরা দেখছি। জঙ্গিবাদের ধারা সেই সময় (১৯৭৫ সাল) থেকে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে সমস্ত কিছুর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে।”

“৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেটা ঘটেছে। ৯০ পরবর্তী সময়ে... যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলে নিজেদের দাবি করে তাদের মধ্যে আমরা স্পষ্টভাবে আপোষকামিতা দেখতে পেয়েছি।”

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কারো কারো মধ‌্যে আপোষকামিতা ঢুকে গেছে মন্ত‌ব‌্য করে তিনি বলেন, “একদিকে সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, অন্যদিকে যারা এটা (জঙ্গিবাদ) প্রতিরোধ করতে পারতো তাদের মধ্যে আপোষকামিতা ঢুকে গেছে।

“কারণ ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়া তাদের কাছে অনেক বড় একটা বিষয়। রাজনীতির চরিত্র সেটা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।”

গণজাগরণ আন্দোলনের কর্মী রাজীব হায়দারসহ ব্লগার হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, “আজকে হোলি আর্টিজানের কথা বলছি। প্রচণ্ডভাবে নাড়া খেয়েছি আমরা। আমরা কি নাড়া খেয়েছি যখন অভিজিৎকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে? আমরা কি নাড়া খাইনি যখন রাজীবকে হত্যা করা হয়েছে? দীপন কে হত্যা করা হয়েছে। যদি নাড়া না খেয়ে থাকি, কেন খাইনি? কেন তখন আমাদেরকে এইভাবে বিচলিত করেনি? কারণ ভিতরে ভিতরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটার পরিবেশটাকে তৈরি করে নেওয়া হয়েছে।”

চিহ্নিত তিন জঙ্গির বিচার শুরু না হওয়ার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন তিনি।

সুলতানা কামাল বলেন, “তিনজন অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের জঙ্গির বিচার শুরু করা যায়নি। এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করছে। যেই মন্ত্রণালয় বলছে অনুমতি চাওয়া হয়নি, আরেক মন্ত্রণালয় বলছে অনুমতি দেওয়া হয়নি। অনুমতি চাইলোনাটা কে, অনুমতি দিলোনাটাকে। আমরাতো আর এত বোকা নই। এর পিছনে নিশ্চয়ই অন্য কোন ব্যাপার রয়েছে বা অন্য কোন স্বার্থ জড়িত রয়েছে।”

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি (সিপিবি) মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “যুব সমাজকে ঠিকমতো অ্যাড্রেস করতে না পারলে দানবের (জঙ্গিবাদ) বিরুদ্ধে সংগ্রাম সফল হতে পারবেন না।”

বর্তমান সময়ে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ‘ইতিহাসের শাস্তি’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পর সাংস্কৃতিক বিপ্লব করার দরকার ছিলো। মনজগতে চার নীতির (গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা) সপক্ষে দুর্গ গড়ার কথা বুঝি নাই।”

খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে সিপিবি সভাপতি বলেন, “বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বললে যাবজ্জীবন- এই ব্লাসফেমি আইন গ্রহনযোগ্য হতে পারে না; হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। ধর্মের মত ইতিহাস নিয়ে ব্লাসফেমি আইন করা যাবে না।”

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সাদেকা হালিম নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে তিন জনের নিহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “আমরা জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করছি। ছেলে মেয়েরা কেন যোগ দিচ্ছে সেটা আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আমরা খবর পেয়েছি, নারায়ণগঞ্জে তিন জন এনকাউন্টারে মারা গেছে। এনকাউন্টার সমাধান কীনা সেটা দেখতে হবে। এর বীজ অনেক গভীরে।”

সাবেক এই তথ্য কমিশনার শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রসঙ্গে তুলে ধরে তিনি বলেন, “ধর্মীয় শিক্ষার বইতে সুরার অনুবাদে আছে, অমুসলিমরা যদি যুদ্ধ করতে আসে, তাদের বুক চিরে কলিজা বের করে আনতে হবে। শিশুদের এই শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আমরা আসলেই অসাম্প্রদায়িক কীনা সেটা প্রশ্ন তুলতে হবে।

“সর্ষের মধ্যেই ভুত আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িকীতে জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলা হলো। তদন্ত কমিটি এখনও বসেনি। শিক্ষার্থীরা এখনও প্রশ্ন করে জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক কীনা।”

রাজধানীর এশিয়াটিক সোসাইটির মিলনায়তনে ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন যুব ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল।

আরো বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক অজয় রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএম আকাশ, ঐক্য ন্যাপের আহ্বায়ক পঙ্কজ ভট্টাচার্য, যুব ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক শিশির চক্রবর্তী প্রমুখ।