মীর কাসেমের রিভিউ শুনানি ফের রোববার

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে মীর কাসেম আলীর করা আবেদনের শুনানি শুরুর পর রোববার পর্যন্ত মুলতবি করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 August 2016, 04:16 AM
Updated : 24 August 2016, 05:12 PM

বুধবার সকালে কাসেমের আইনজীবীর সময়ের আবেদন নাকচ করে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ রিভিউ শুনানি শুরু করে।

প্রথমে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন তার বক্তব‌্য উপস্থাপন শুরু করেন। এর পরপরই আদালত শুনানি রোববার পর্যন্ত মুলতবি করে দেয়।

আপিল বিভাগের এ বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।

৬৩ বছর বয়সী জামায়াত নেতা কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার এই আবেদনে তারা কী সিদ্ধান্ত দেন, তা জানার অপেক্ষায় রয়েছে পুরো বাংলাদেশ।

যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের শেষ আইনি সুযোগ এই রিভিউ আবেদন। এ আবেদনে রায়ের কোনো পরিবর্তন না হলে তার সামনে কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ থাকবে।

আবারও শুনানির জন্য আসা রিভিউ আবেদনের সঙ্গে শুনানি মুলতবির আবেদনের বিষয়টিও রাখা ছিল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বুধবারের কার্যতালিকায়।

কার্যতালিকার ৫ নম্বরে থাকা রিভিউ আবেদন সাড়ে ৯টার পর শুনানির জন্য আসলে খন্দকার মাহবুব দাঁড়ান।

প্রস্তুতির জন্য দুই মাস চেয়ে আবেদন করার পর গত ২৫ জুলাই আদালত রিভিউ শুনানি এক মাস পিছিয়ে দেয়। এক মাস পর শুনানির জন্য আসলে ফের এক মাস সময় চেয়ে আবেদন করেন জামায়াতের এই কেন্দ্রীয় শুরা সদসস্যের আইনজীবীরা।

বুধবার খন্দকার মাহবুব সময় আবেদনের কথা বললে প্রধান বিচারপতি তাকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনি যে ‍যুক্তিতে সময় চেয়েছেন, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমার ব্রাদার বিচারপতি এখানে আছেন। তিনি সময় নির্ধারণ করেছেন। আপনি এরপর ৬ সপ্তাহ সময় পেয়েছেন। এরমধ্যে ২৫ জুলাই আপনি সময়ের আবেদন করেছেন।

“আমরা সময় দিয়েছি। অথচ রিভিউয়েরই কোনো আইন নাই। এরপরও আমরা সেই সুযোগ দিয়েছি। যদিও এখানে কনস্টিটিউশনাল বেরিয়ার রয়েছে। আপনি জানেন, রিভিউতে যুক্তি খুবই কম থাকে।”

এ সময় খন্দকার মাহবুব সময়ের জন্য বারবার বলতে থাকলে জবাবে আদালত বলে, “আমরা দুঃখিত।”

এ পর্যায়ে মীর কাসেমের প্রধান এই আইনজীবী আদালতকে তার কাছে মামলার কোনো কাগজপত্র না থাকার কথা বলে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।

“আমার কাছে কিছুই নাই। কাগজপত্রও নাই। এই সব ছিল তার ছেলের নিকট। তাকে কেউ নিয়ে গেছে। সে কেবল তার ছেলেই ছিল না। সে এই মামলার আইনজীবীও ছিল।

“তার কাছেই সব কাগজপত্র ছিল। আমি এই মামলার জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ঠিক আছে। কিন্তু আমার কাছেতো কিছুই নাই। আমি অসহায়,” বলেন খন্দকার মাহবুব।

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমরা ওই যুক্তিতে (সময় মুলতবি) দিব না। হতে পারে সে (মীর কাসেমের ছেলে) তো ইয়ে করতে নাই।”

এক পর্যায়ে খন্দকার মাহবুব বলেন, “আমার কাছে পেপারবুকও নাই। কোনো কাগজপত্র নাই।” 

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমরা তো রায়ের বাইরে যাব না। কোথায় ‘অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড’?”

খন্দকার মাহবুবকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনার কাছে ওইদিনও পেপার বুক ছিল। এখন নাই কেন?”

খন্দকার মাহবুব বলেন, “ওইদিনের পর ওরা নিয়ে গেছে।”

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “ওইদিন আপনি আবেদন করেছেন। আমি সময় দিয়ে দিয়েছি। রাষ্ট্রপক্ষ নানা বক্তব্য দিয়েছে। আমি বলতে গেলে, তাদের বক্তব্য শুনিও নাই। সময় দিয়ে দিয়েছি।”

এরপর নিজের ‘পেপার বুক’ খন্দকার মাহবুবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আমি আমার পেপার বুক দিয়ে দিচ্ছি। আপনি শুনানি শুরু করেন।”

এসময় খন্দকার মাহবুব অন্তত এক সপ্তাহ সময় চান।

জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনাকে আমি বিগত ৪০ বছর যাবত চিনি। ওয়ার ক্রাইম নিয়ে আপনার ইয়ে আমি জানি। আমি আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করি। আশা করি, আপনি আপনার সম্মান রাখবেন।”

এ পর্যায়ে খন্দকার মাহবুব সময়ের জন্য বারবার পীড়াপিড়ি করতে থাকলে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনি শুরু করেন, আমরা রোববার শেষ করব।”

এরপর প্রধান বিচারপতি তার হাতে থাকা পেপারবুক খন্দকার মাহবুবের দিকে বাড়িয়ে দেন।

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তার হাতে থাকা পেপারবুক খন্দকার মাহবুবের সামনে ডায়াসে এগিয়ে দেন।

এই পর্যায়ে পেপার বুক ছাড়াই শুরু করতে পারবেন বলে জানান খন্দকার মাহবুব।

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনি শুরু করেন, আপনার স্মরণশক্তি ভালো আমি জানি।”

খন্দকার মাহবুব বলেন, “আমি একটা অভিযোগের ওপর বক্তব্য রাখব। যে অভিযোগে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।”

এ সময় আনুষঙ্গিক কিছু কথা বলেন খন্দকার মাহবুব। এক পর্যায়ে আদালত রোববার পর্যন্ত মুলতবি করে।

প্রধান বিচারপতি জানান, এটা ‘আংশিক শ্রুত’ হিসেবে রোববার কার্যতালিকার শীর্ষে আসবে।

২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর গত ৮ মার্চ আপিলের রায়ে ওই সাজাই বহাল থাকে। ৬ জুন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন‌্য ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাসেম।

রাষ্ট্রপক্ষ এরপর রিভিউ শুনানির দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে। এর ধারাবাহিকতায় ২১ জুন চেম্বার বিচারপতি বিষয়টি নিয়মিত আপিল বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান।

মামলাটি ২৫ জুলাইয়ের কার্যতালিকায় আসার পর মীর কাসেমের আইনজীবীর সময়ের আবেদনে শুনানি পিছিয়ে যায়।

রিভিউ খারিজ হলে এবং তিনি প্রাণভিক্ষা না চাইলে কিংবা আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে কোনো বাধা থাকবে না।

মীর কাসেম এখন আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে।

দণ্ড মওকুফ চেয়ে ৮৬ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ১৪টি যুক্তি তুলে ধরেছেন মীর কাসেম। রিভিউ দায়েরের পর তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, এতে ‘ন্যায়বিচার’ পাবেন বলে তারা ‘প্রত্যাশা’ করছেন।

অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অতীত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ফৌজদারি মামলায় পুনর্বিবেচনায় রায় বদলের খুবই ‘খুবই সীমিত’।

যে অভিযোগে ফাঁসি

অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

ট্রাইব্যুনালে তিন বিচারকের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় হয়। আপিলেও তা বহাল থাকে। এছাড়া আরও ছয় অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে মীর কাসেমের আগে রিভিউ করে বিফল হয়েছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা।

রিভিউ খারিজের পর তাদের সবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সর্বশেষ গত মে মাসে নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের ছয় দিনের মাথায় তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে কাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।

এ মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে রায়ে।

একাত্তরে মীর কাসেমের নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।

ডালিম হোটেল ছাড়াও নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর আলাদা ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল সে সময়।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শূরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত এসেছে।