বুধবার ভোরে এই অভিযান চালানো হয় বলে র্যাব-১-এর উপ-অধিনায়ক মেজর মো. সফিউল আজম জানান।
আটকরা হলেন- জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত আমির ও নারী শাখার প্রশিক্ষক রাশেদুজ্জামান রোজ (৩০), ঝিনাইদহের সাইটবাড়িয়া এলাকার মোহাম্মদ আব্দুল হাই (৩৬), জেএমবির আত্মঘাতী বাহিনীর সদস্য দিনাজপুরের মারুপাড়া এলাকার শাহাবুদ্দিন (২৩), সিরাজগঞ্জের বাদুলাপুর এলাকার ফিরোজ আহমেদ শেখ (২৭) এবং মুন্সিগঞ্জের কৈলাদি এলাকার সাইফুল ইসলাম (২৯)।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, গত ২১ জুলাই টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার জেএমবি নেতা মাহমুদ হাসান এবং ১৬ অগাস্ট ঢাকায় গ্রেপ্তার জেএমবির নারী শাখার উপদেষ্টা আকলিমা রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে তারা টঙ্গীতে অভিযান চালান। স্টেশন রোড এলাকা থেকে আটক করা হয় রাশেদুজ্জামান রোজ, আব্দুল হাই ও শাহাবুদ্দিনকে।
পরে তাদের দেওয়া তথ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ছয়দানার হাজীর পুকুর এলাকায় দুটি দোকানে অভিযান চালিয়ে ফিরোজ ও সাইফুলকে আটক করা হয়।
ওই দুই দোকানে ধর্মীয় বইয়ের ভেতরে কৌশলে লুকিয়ে রাখা দুটি পিস্তল, আট রাউন্ড গুলি, দুটি ম্যাগজিন, তিনটি হাতবোমা, ছয়টি ডেটোনেটর, দুটি চাপাতি এবং বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম ও উগ্র মতবাদের বই পাওয়া যায় বলে মুফতি মাহমুদ খান জানান।
“প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে, রাশেদুজ্জামান রোজ ও আব্দুল হাই চট্টগ্রাম থেকে এবং সাহাবুদ্দিন পাবনা থেকে টঙ্গীতে জড়ো হন। এরপর নাশকতার জন্য বিস্ফোরক সংগ্রহ করতে তারা গাজীপুরে ফিরোজ ও সাইফুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের জঙ্গি দলের অস্তিত্ব জানান দিতে নাশকতা পরিচালনা করা।”
উপ-অধিনায়ক সফিউল আজম জানান, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় রাশেদুজ্জামানের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে তথ্য পেয়েছেন তারা।
“শোলাকিয়ায় নিহত জঙ্গি ও গাজীপুরে আটক সবাই একই জায়গা থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।”
গত ৭ জুলাই সকালে শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতের কাছে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলার ঘটনায় দুই পুলিশ নিহত হন। জানালা দিয়ে আসা গুলিতে নিজের ঘরে মারা যান এক গৃহবধূ। এছাড়া পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এক হামলাকারী।
রাশেদুজ্জামান রোজ
র্যাব বলছে, ঝিনাইদহ থেকে এইচএসসি পাস করার পর রাশেদুজ্জামান রোজ মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেলেও আইইউবিতে বিবিএ ভর্তি হন। সেখানে দুই সেমিস্টার পড়ে পাড়ি জমান কানাডায়। সেখানে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করার সময় মধ্যপ্রাচ্য ও সিরিয়ার কয়েজন তরুণের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হন। পরে গ্রামে ফিরে ২০১৪ সালে তিনি জ্বালানি তেলের ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময় আব্দুল হাইয়ের মাধ্যমে জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলীয় আমীর মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
পরে মাহমুদুলের কাছ থেকে রোজ জেএমবির নারী শাখা পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পান। সেখানে তার পরিচয় হয় আকলিমার সঙ্গে। গত জুলাই মাসে মাহামুদুল গ্রেপ্তার হলে রোজ জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলীয় শাখার ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
তার ল্যাপটপে কিছু ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে, যার মাধ্যমে তিনি জঙ্গিদের ‘নৃশংস হওয়ার প্রশিক্ষণ’ দিতেন বলে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
আব্দুল হাই
র্যাব বলছে, আহলে হাদিস আন্দোলনের ঝিনাইদহ শাখার এক সময়ের সেক্রেটারি মো. আব্দুল হাই ঝিনাইদহে একজন ইমাম হিসেবে পরিচিত হলেও বিভিন্ন সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষক, হোমিও চিকিৎসক ও মোবাইল টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
হাই ২০১০ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে শিশুদের জন্য সহজ কোরআন শিক্ষা কার্যক্রমে যোগ দিলেও চার বছরের মাথায় চাকরিচ্যুত হন। তিনি যশোর ও ঝিনাইদহ এলাকায় বিভিন্ন সময় জেএমবির বৈঠক আয়োজন করতেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী, দক্ষিণাঞ্চল থেকে জেএমবি সদস্য সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণের জন্য ফিরোজের কাছে পাঠানো হত বলে জানতে পেরেছে র্যাব।
শাহাবুদ্দিন ওরফে শিহাব ওরফে রকি
র্যাব বলছে, জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য শাহাবুদ্দিন শোলাকিয়া হামলায় অংশগ্রহণকারী শফিউলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তারা একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং একাধিক ‘মিশনে’ একসঙ্গে অংশ নিয়েছেন।
শাহাবুদ্দিন তিন বছর আগে শফিউলের মাধ্যমে জেএমবিতে যোগ দেন; পরে আত্মঘাতী স্কোয়াডের অন্তর্ভুক্ত হন। জঙ্গি হামলার সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য ফিরোজের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বলে র্যাবের ভাষ্য।
মো. ফিরোজ আহম্মেদ শেখ ওরফে আনসার
এক সময় গার্মেন্ট ও এমএলএম কোম্পানি ডেস্টিনিতে কাজ করা ফিরোজ ২০১০ সালে মাহমুদুল হাসানের মাধ্যমে জেএমবিতে যোগ দেন। পরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতা জসীমউদ্দিন রাহমানির দোকানে ২/৩ মাস চাকরিও করেন।
জসীমউদ্দিন গ্রেপ্তার হলে গাজীপুরে গিয়ে বইয়ের দোকান খোলেন ফিরোজ। মাহমুদুলের নির্দেশে লাইব্রেরি ব্যবসার আড়ালে তিনি অস্ত্র ও বিস্ফোরক মজুদ করছিলেন। তার সেই লাইব্রেরি জঙ্গিদের বৈঠক ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত বলে র্যাবের তথ্য।
মো. সাইফুল ইসলাম
মাদ্রাসা পাস করে ২০১০ সালের দিকে ঢাকার তানজিম সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কাজ করার সময় এক ‘বড় ভাইয়ের’ মাধ্যমে হাজিরপুকুর জামে মসজিদের মোয়াজ্জিনের চাকরি পান সাইফুল। ওই মসজিদের নিচে বই বিক্রি করতেন ফিরোজ। সেখানেই তাদের মধ্যে সখ্যতা হয় এবং সাইফুল জেএমবিতে যোগ দেন বলে জানিয়েছে র্যাব।
সাইফুল পরে ফিরোজের বইয়ের দোকানের পাশে মোবাইলের বিল রিচার্জ ওমানি ট্রান্সফারের ব্যবসা শুরু করেন। তার মাধ্যমেই জেএমবির আর্থিক লেনদেন চলত এবং তিনিই ভুয়া নামে নিবন্ধিত সিম জেএমবি সদস্যদের সরবরাহ করতেন বলে র্যাবের তথ্য।