মরার আগে মরতে রাজি না: হাসিনা

২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মৃত্যু ভয় না থাকায় কোনো মানুষের কাছে মাথা নোয়ান না তিনি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2016, 01:46 PM
Updated : 21 August 2016, 05:42 PM

শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ওই গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, যাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভী রহমানসহ ২৪ জন।

হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হাসিনার।

হামলার ১২ বছরপূর্তিতে রোববার ভয়াবহ ওই ঘটনা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, “আমি কখনো মৃত্যুকে ভয় করি না। কারো কাছে আমি মাথা নত করি না, ওপরে আল্লাহ ছাড়া। একমাত্র আল্লাহর কাছেই সেজদা দেই, আল্লাহর কাছেই মাথা নত করি।  আর কারও কাছে না। 

“মরার আগে মরতে আমি রাজি না, আমি জাতির পিতার কন্যা।”

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূলের প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন,“আমাদের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত স্পষ্ট, আমরা কোনো সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ চাই না।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “যেখানে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে ষড়যন্ত্রের গভীরতা উপলব্ধি করে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।” 

সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পিছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তি রয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “সবদিক থেকে বাংলাদেশ যখন সুস্থভাবে চলছে, তখনও দেখা যাচ্ছে- দেশের ভিতরে কিছু আর কিছু বিদেশি শক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা করেছে, নানা ধরনের চক্রান্ত করেছে, যারা আমাদের সম্পদ অন্যের কাছে বেচতে চেয়েছে, নানা ধরনের চক্রান্ত এখনও চলছে।”

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দূর করতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা জানিয়ে  তিনি বলেন, “সেখানেই এদেরকে মদদ দিয়ে নানা ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

“ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সারাজীবনই বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে।”

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে সম্প্রতি প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে মসজিদের ইমামসহ দুজনকে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “কোনো দেশেই আর কেউ নিরাপদ নয়। 

“সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের একার না, সারা বিশ্বে এ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।”  

বক্তব্যের আগে বিকালে শেখ হাসিনা  বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এসে পৌঁছালে  আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাকে স্বাগত জানান।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে পৌঁছেই শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথমে ২১ অগাস্টে নিহতদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

এরপর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শেখ হাসিনা। এসময় সৈয়দ আশরাফ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ, উপদেষ্ট পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমদসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। 

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতারের নেতত্বে ১৪ দল এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মেয়র সাঈদ খোকন অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

২১ অগাস্ট হামলার জন্য সে সময় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, “এই ঘটনার পর সংসদে আমাদের একটি কথা বলতে দেওয়া হয়নি। এই ঘটনার নিন্দা করে নিন্দা প্রস্তাব দিতে দেওয়া হয়নি। কারণ কী? এতেই তো স্পষ্ট-কারা এর সাথে জড়িত ছিল। কাউকে আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয় না।” 

হামলার দিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “সেদিন পুলিশের কোনো তৎপরতাই ছিল না। এমনকি সেদিন আশপাশের কোনো ভবনের ছাদে আমাদের কোনো স্বেচ্ছাসেবককে যেতে দেয়নি। কাউকে সেদিন নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করতে দেয়নি। কেন দেয়নি?”

হামলার পর আহতদের উদ্ধার না করে পুলিশ উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জ করে।  

শেখ হাসিনা বলেন, “কেন পুলিশ এভাবে লাঠিচার্জ করল? আর টিয়ার গ্যাস মারল? এটা আর কিছুই না; যারা হামলাকারী তারা যাতে নিরাপদে এই জায়গা থেকে চলে যেতে পারে, সেই সুযোগটা সৃষ্টি করার জন্যই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল।

“আহতদের উদ্ধারের কোনো চেষ্ট করা হয়নি, কোনো গাড়ি, ভ্যান, রিকশা আসতে দেয়নি।”

২১ অগাস্টে ওই হামলার আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের নিজেদের বাসা ছেড়ে ধানমণ্ডিতে শ্বশুর বাড়িতে ৮ থেকে ১০ মাস অবস্থানের কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “কেনো ছিল? ষড়যন্ত্রগুলো ওখানে বসে করতে সুবিধা, তাই?”

ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলার আলামত সংগ্রহ না করায় বিস্ময় প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এটা কীভাবে সম্ভব?

“তাদের (বিএনপি) এমপি এবং খালেদা জিয়ার বক্তব্যে এটা স্পষ্ট ছিল, আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে চিরতরে।”

২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার কিছুদিন আগে এক বক্তৃতায় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়া তো দূরের কথা, বিরোধীদলের নেতাও কোনোদিন হতে পারবেন না শেখ হাসিনা। 

তার বক্তব্য উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এই বক্তৃতার সূত্র ধরে যদি ২১ অগাস্টের ঘটনা দেখি, তাহলে কী দাঁড়ায় ?”

ওই দিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “যে মুহূর্তে আমি আমার বক্তব্য শেষ করে ‘জয় বাংলা’ বলে হাতের মাইকটা টেবিলে রেখেছি, তখনই সেই গ্রেনেড হামলা শুরু হল। একটার পর একটা গ্রেনেড মারা হচ্ছে। প্রথম তিনটা গ্রেনেড মারার পরে কয়েক সেকেন্ড সময়, এরপর আবার একটার পর একটা গ্রেনেড।

“জানি না আমার কী ভাগ্য! গ্রেনেড ট্রাকের ভিতরেই পড়ার কথা। কিন্তু সেখানে না পড়ে ডালায় লেগে পাশে পড়ে যায়।” 

সে সময় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফসহ শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে তাকে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার থেকে রক্ষা করেন।  

শেখ হাসিনা বলেন, “একটার পর একটা গ্রেনেড মেরেছে। ১৩টা গ্রেনেড তারা ছুড়েছিল, মনে হচ্ছিল ‘কেয়ামত’ এসে গেছে। আমার চোখের চশমা ছিটকে পড়ে যায়। দূরে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ওই অবস্থায় আমার সাথে নিরাপত্তায় যারা ছিল, তারা যখন পাল্টা গুলি ছুড়ল তখনই ওটা থামল। 

“আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে র‌্যালি করতে গিয়ে নিজেরাই সন্ত্রাসের শিকার হলাম।”

পরে প্রধানমন্ত্রী ২১ অগাস্ট হামলায় নিহতদের স্বজন এবং আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।