আলোকচিত্রে মুক্তিযুদ্ধের অদেখা অধ্যায়

একাত্তরে রণাঙ্গনে যখন বাংলার দামাল ছেলেরা লড়ছে জীবন বাজি রেখে, তখন হাজার মাইল দূরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বাংলাদেশের সমর্থনে পথে নেমেছে প্রবাসী বাঙালিরা। পঁচিশে মার্চের কালোরাতের গণহত্যার ঘটনায় তাদের পক্ষে শোর তুলেছে ব্রিটিশরাও। লন্ডনব্যাপী প্রবল আন্দোলনে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায় ব্রিটিশ সরকারও।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2016, 04:05 PM
Updated : 18 August 2016, 04:06 PM

মুক্তিযুদ্ধের সেই অধ্যায়ের গল্প নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা একাডেমির গ্যালারি-৫ এ শুরু হয়েছে ‘লন্ডন ১৯৭১: ভিনদেশে বাঙালির আগুনঝরা দিনের গল্প’ শীর্ষক প্রদর্শনী।

বৃহস্পতিবার থেকে শুরু তিন দিনব্যাপী এ প্রদর্শনীর আয়োজন ‘প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’ নামের একটি সংগঠন।

বিকালে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে লন্ডনে বাংলাদেশের জন্য একটি বৃহৎ সমাজ গড়ে উঠেছিল। তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন, নানা সাহায্য-সহযোগিতার কথা কখনও ভোলার নয়।

“মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার পর বেতারবার্তা সম্প্রচারের জন্য যন্ত্রাংশ পাঠিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান ভুমিকা পালন করেছিল ব্রিটিশরা।”

প্রদর্শনীটিকে ‘প্রশংসনীয় উদ্যোগ’ অভিহিত করে অর্থমন্ত্রী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল, তা থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। এখন আমি জোরেশোরেই বলতে পারি, যে আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হচ্ছে।”

উদ্বোধনীতে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “পরিস্থিতির কারণেই হোক কিংবা আমাদের অবহেলা-উদাসীনতাতেই হোক, আমরা মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিচিহ্ন, নিদর্শন হারিয়ে ফেলেছি।

“মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে এসে আমরা ইতিহাসকে নতুনভাবে জানি, যা আমাদের স্মৃতিকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়।”

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশপ্রেমিক প্রবাসী বাঙালিদের জোর আন্দোলনের কারণেই ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াল।

“বিশ্ব রাজনীতিকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম আমরা, যার অস্তিত্বে লাল-সবুজের পতাকা মিশে আছে, তারা কখনও বাংলাদেশ ইস্যুতে আপোষ করে না।”

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশিরভাগ ছবি ব্রিটিশ আলোকচিত্রী রজার গোয়েন ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউসুফ চৌধুরীর তোলা। এছাড়া রয়েছে বেশকিছু সংগৃহীত ছবি।

গত আট বছর ধরে লন্ডনে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুরে ঘুরে এসব ছবি সংগ্রহ করেছেন উজ্জ্বল দাশ। এছাড়া লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রের মূল কপি, পোস্টার, ডাকটিকেট ও প্রচারপত্র স্থান পেয়েছে এ প্রদর্শনীতে।

বাঙালিদের পাশাপাশি একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে বিশ্ব জনমত গঠনে ব্রিটিশ সাংসদ, রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণীর মানুষ রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে সেসব ভিনদেশী বন্ধুদেরও ছবি।

প্রদর্শনী প্রসঙ্গে উজ্জ্বল দাশ বলেন, “এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশের তরুণ বাঙালি প্রজন্মকে একাত্তরে ভিন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভূমিকাটি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। এটাই আমাদের প্রথম প্রদর্শনী এবং এই ছবিগুলো এর আগে কোথাও প্রদর্শিত হয়নি।”

অদূর ভবিষ্যতে সিলেট এবং দেশের বাইরে লন্ডন ও বার্মিংহামে এসব আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি।

প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ভিনদেশে বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে গড়ে ওঠা প্রবাসী ও লন্ডনবাসীর সভা-সমাবেশ, মিছিল কিংবা বিক্ষোভের ছবি।

একাত্তরের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম লিপিকার এ কে এম আবদুর রউফের হাতে আঁকা ঐতিহাসিক পোস্টারটি স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। এসব ছবির মধ্যে আছে একাত্তরের লন্ডনের হাইড পার্ক স্পিকার্স কর্নারে মুক্তিকামী জনতার সমাবেশ।

সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবিতে বিভিন্ন পোস্টার ও তার ছবি প্রদর্শন করছেন বিক্ষোভকারীরা। এসব সমাবেশে বাঙালিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন বিলেতবাসীও।

প্রদর্শনীতে দেখা যায়, একাত্তরের ৪ জুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট্রের দিকে এগিয়ে চলেছে ইউকে মহিলা সমিতির ‘দুর্বার’ মিছিল। একাত্তরের পয়লা অগাস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার দেখা মেলে একটি ছবিতে। আছে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারির একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি।

পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু সরাসরি পৌঁছে যান লন্ডনে। সেখানের ক্লারিজ হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন জাতির জনক।

অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালিদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠিটিও রয়েছে প্রদর্শনীতে।

প্রদর্শনী শেষ হবে শনিবার। জাতীয় চিত্রশালার ৫ নম্বর গ্যালারিতে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী খোলা থাকবে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।