আলোচিত ৩ মামলার পেপারবুক হাই কোর্টে

আলোচিত তিন মামলার পেপারবুক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছাপানোর পর সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছে; সরকারি ছাপাখানায় রয়েছে আরও এক মামলার পেপারবুক।

মহিউদ্দিন ফারুকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2016, 07:54 AM
Updated : 29 July 2016, 09:34 AM

হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মো. সাব্বির ফয়েজ (প্রশাসন ও বিচার) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সিলেটের শিশু সামিউল আলম রাজন, খুলনার রাকিব হাওলাদার এবং ঢাকায় পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান  ও তার স্ত্রী হত্যা মামলার পেপারবুক সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছে।

আর গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার আসামিদের ডেথ রেফারেন্সের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুত হচ্ছে।

“পেপারবুক প্রস্তুতের পর মামলাগুলো প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপন করা হবে। প্রধান বিচারপতি যদি এসব মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন, তাহলে তা হাই কোর্টে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে যাবে এবং শুনানি হবে।”

আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর আগে ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা, সৌদী দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ আল আলী হত্যা মামলাতেও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (রায়সহ মামলার নথি) প্রস্তুত করা হয়েছিল। অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই উচ্চ আদালতে এসব মামলার নিষ্পত্তি হয়।

নিহত রাকিব হাওলাদার, ফাইল ছবি

রাকিব হত্যা মামলা

গতবছর ৩ অগাস্ট খুলনা নগরীর টুটপাড়া কবরখানা মোড়ে শরীফ মোটর্স নামের এক মোটর গ্যারেজে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসার মেশিনের মাধ্যমে মলদ্বারে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করা হয় শিশু রাকিবকে।

ওই মামলায় গত বছরের ৮ নভেম্বর রায় দেয় খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালত। তিন আসামির মধ্যে শরীফ মোটর্সের মালিক ওমর শরীফ এবং তার দূর সম্পর্কের চাচা মিন্টু মিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারক। আর শরীফের মা বিউটি বেগমকে খালাস দেওয়া হয়।

বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার নথিপত্র গত ১০ নভেম্বর হাই কোর্টে পৌঁছায় এবং নথিভুক্ত হয়।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এ মামলার পেপারবুক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রস্তুত করতে সংশ্লিষ্ট শাখাকে নির্দেশ দেন। আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে গত বছর ২০ ডিসেম্বর পেপারবুক ছাপার জন্য সরকারি ছাপাখানায় পাঠানো হয়, যা ইতোমধ্যে ছাপা হয়ে সুপ্রিম কোর্টে এসেছে। এর সঙ্গে রয়েছে আসামিদের চারটি আপিল বা জেল-আপিল।

ইউটিউব ভিডিও থেকে নেওয়া ছবিতে রাজনের ওপর নির্যাতনের দৃশ্য।

রাজন হত্যা মামলা

গতবছর ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অভিযোগ তুলে ১৩ বছরের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর দুই দিনের মাথায় পালিয়ে সৌদি আরবে চলে যান মূল আসামি কামরুল।

সেই নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে প্রবাসীদের সহযোগিতায় সৌদি আরবে আটক হন কামরুল। সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে একই বছরের ১৫ অক্টোবর তাকে দেশে ফিরিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

রাজনকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় গত ৮ নভেম্বর সিলেটের মহানগর দায়রা জজ রায় ঘোষণা করে। রায়ে প্রধান আসামি কামরুল ইসলামসহ চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত।

কামরুল ছাড়া বাকি তিনজন হলেন- ময়না চৌকিদার, তাজউদ্দিন আহমদ বাদল ও জাকির হোসেন পাভেল আহমদ।

রায়ে আসামি নূর মিয়ার যাবজ্জীবন সাজার আদেশ হয়। কামরুলের এই সহযোগীই রাজনকে নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করেন, তারপর ছড়িয়ে দেন ইন্টারনেটে।

কামরুলের তিন ভাই মুহিত আলম, আলী হায়দার ও শামীম আহমদকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। এক বছর করে দণ্ড হয়েছে দুলাল আহমদ ও আয়াজ আলীর।

অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় ফিরোজ মিয়া, আজমত উল্লাহ ও রুহুল আমিন এ মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।

বিচারিক আদালতের ওই রায়সহ মামলার নথিপত্র গত ১০ নভেম্বর হাই কোর্টে পৌঁছায় এবং ডেথরেফারেন্স নথিভুক্ত হয়।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নির্দেশে গত ২০ ডিসেম্বর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক ছাপার জন্য ছাপাখানায় পাঠানো হয়। সেই পেপারবুকও সুপ্রিম কোর্টে এসেছে, সঙ্গে রয়েছে আসামিদের সাতটি আপিল বা জেল আপিল।

ফাইল ছবি

পুলিশ কর্মকর্তা ও স্ত্রী হত্যা

স্ত্রী, দুই সন্তান ও শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে থাকতেন পুলিশের বিশেষ শাখার (রাজনৈতিক) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। ২০১৩ সালের ১৬ অগাস্ট ওই বাসা থেকে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, আগের রাতে কোনো এক সময়ে কফির সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করেন তাদের মেয়ে ঐশী রহমান।

গতবছর ১২ নভেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ওই দম্পতিকে হত্যার দায়ে তাদের মেয়ে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার জন্য ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে মামলার অপর আসামি ঐশীর আরেক বন্ধু আসাদুজ্জামান জনি খালাস পান।

বিচারিক আদালতের রায়সহ নথিপত্র হাই কোর্টে আসে গত বছরের ১৯ নভেম্বর; পরে ডেথরেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়।

আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে গত বছরের ডিসেম্বর পেপারবুক ছাপার জন্য সরকারি ছাপাখানায় পাঠানো হয়। পেপারবুক ছাপা হয়ে ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে এসেছে, এর সঙ্গে রয়েছে আসামিদের দুটি আপিল বা জেল আপিল।

ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার

ব্লগার রাজীব হত্যা মামলা

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর দশম দিনে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে রাজধানীর পল্লবীতে তার বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ওই ঘটনায় রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিনের করা মামলার তদন্তে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য উঠে আসে।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার-৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ মামলার রায়ে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র পলাতক রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ ছাড়া একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ পাঁচজনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ হয়।

ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার আট আসামির মধ্যে জসীমউদ্দিন রাহমানী ছাড়া বাকিরা সবাই নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর মামলার নথিপত্র চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি হাই কোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পৌঁছায় এবং নথিভুক্ত হয়।

পরে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিলে মে মাসে পেপারবুক ছাপানোর জন্য সরকারি ছাপাখানায় পাঠানো হয়।

ডেথ রেফারেন্স ও পেপারবুক

নিম্ন আদালতের রায়ে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরের জন্য হাই কোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত।

পাশাপাশি আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত আসামিরা আপিল ও জেল আপিল করার সুযোগ পান। ডেথ রেফারেন্সের শুনানির প্রস্তুতি হিসেবে পেপারববুক তৈরি করতে হয়। পেপার বুকে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, জব্দ তালিকা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও নিম্ন আদালতের রায় পর্যায়ক্রমে সাজানো থাকে।

রেজিস্ট্রার দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, গতবছর শেষে হাই কোর্টের হাতে মোট ৪১৯টি ডেথ রেফারেন্স মামলা ছিল। চলতি বছরের মে পর্যন্ত সময়ে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৬৬টি। আর এই সময়ে ২৯টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।

ডেথ রেফারেন্স শাখার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্তমানে ২০১০ ও ২০১১ সালের ডেথ রেফারেন্সর ওপর হাই কোর্টে শুনানি হচ্ছে। ২০১২ সালের ডেথ রেফারেন্স সরকারি ছাপাখানায় পাঠানোর জন্য কম্পোজের কাজ চলছে।

বর্তমানে হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য নিয়মিত দুটি বেঞ্চ আছে। এর পাশাপাশি দুটি বেঞ্চের একটি সপ্তাহে এক দিন, অন্য বেঞ্চ সপ্তাহে দুই দিন ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি করে থাকে।

চলতি বছরই সাবেক ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলা ও গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা ও সর্বশেষ ২৮ জুলাই গাজীপুর আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বোমা হামলার চাঞ্চল্যকর মামলায় ডেথ রেফারেন্সের নিষ্পত্তি হয়েছে হাই কোর্টে।

আর আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা পিলখানা হত্যা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিলের ওপর হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চে শুনানি অব্যাহত রয়েছে।