বাঘ-মানুষের ‘দ্বন্দ্ব’ কমলেও থামেনি চোরা শিকার

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনার কথা বন অধিদপ্তর দাবি করলেও থেমে নেই চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম।

মঈনুল হক চৌধুরীও অলীপ ঘটকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2016, 06:04 AM
Updated : 29 July 2016, 06:48 AM

বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের ২০০৯ সালের জরিপে বাংলাদেশে চারশ থেকে সাড়ে চারশ রয়েল বেঙ্গল টাইগার থাকার কথা বলা হলেও এ বছর বন বিভাগ ও ওয়াইল্ডলাইফ ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়ার ক্যামেরা পদ্ধতির জরিপে বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৬টিতে।

২০০১ সাল থেকে চলতি বছরের ২৮ জুলাই পর্যন্ত সময়ে চোরা শিকারীদের হাতে অন্তত আটটি বাঘের মৃত্যু হয়েছে বলে সুন্দরবন বিভাগের বনসংরক্ষক (সিএফ) জহির উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের সুন্দরবন থেকে বাঘ হত্যা করে এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিদেশে পাচারের সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য এবং প্রভাবশালীরাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

বন কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযাযী, গত পনের বছরে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে ৩২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে; অন্যদিকে মানুষের হাতে মারা পড়েছে অন্তত ৩০টি বাঘ। বন অধিদপ্তর বলছে, গেল তিন বছরে লোকালয়ে আসা কোনো বাঘ মারা যায়নি।

বন অধিদপ্তরের প্রধান বনসংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব কমাতে পারা আমাদের একটা বড় সফলতা। কিন্তু সুন্দরবনে বিশাল আন্তর্জতাকি বর্ডার যেমন রয়েছে, তাতে বাঘ শিকারের বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে। চোরা শিকার, হরিণ পাচার- এটা বাঘের বড় থ্রেট”।

প্রকৃতি সংরক্ষণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক উপ-প্রধান বন সংরক্ষক তপন কুমার দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাম্প্রতিককালে বন বিভাগ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত কর্মতৎপরতায় বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্বে জীবনহানি কমেছে। বিশেষ করে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে লোকালয়ে চলে আসা কোনো বাঘ মারা যায়নি। বাঘের আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।”

তবে চোরা শিকারির উৎপাত বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, র‌্যাব ও পুলিশের হাতে চারটি বাঘের চামড়া ধরা পড়েছে এই সময়ে।

বন সুরক্ষায় ‘স্মার্ট পেট্রলিং’সহ কিছু উদ্যোগ থাকলেও নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন প্রধান বন সংরক্ষক।

খুলনার কয়রায় বাঘের চামড়া বেচা-কেনার সময় দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

তিনি বলেন, “পুরো সুন্দরবনের জন্য মাত্র ৭০০ লোকবল, মানে ১০ বর্গ কিলোমিটারে একজন। এটা বড় দুর্বলতা। সুন্দরবনে যে কাজেই যাক না কেনো নৌ লাইসেন্স ও অনুমতি নিশ্চিত করতে হবে। কোথাও কোথাও তা করতে পারিনি।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোরা শিকারীদের পাশাপাশি বনের ভিতর দিয়ে লাগামহীনভাবে নৌচলাচল, সুন্দরবনের পাশে বৃহৎ আকার শিল্প অবকাঠামো নির্মান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, লোকালয় সংলগ্ন খাল-নদী ভরাট এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাঘের অস্তিত্ব রক্ষার পথে বাধা হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার দে জানান, সুন্দরবনে বাঘের শিকার প্রাণীর মধ্যে চিত্রা হরিণ, শুকর, মায়া হরিণ ও বানর রয়েছে। বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে শিকার প্রাণির সংখ্যা বাড়াতে হবে।

“এখনই সকলকে আমাদের জাতীয় প্রাণী বাঘ সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ বিপন্ন প্রাণীটি দেশ থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে।”

রয়েল বেঙ্গল টাইগার

>> বিশ্বের সর্ববৃহৎ একক ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (বাদাবন) সুন্দরবনে এই বাঘের বসবাস।

>> পূর্ণ বয়স্ক বাঘের ওজন সর্বোচ্চ ২২০ কেজি, বাঘিনীর ওজন সর্বোচ্চ ১৬০ কেজি।

>> প্রাকৃতিক পরিবেশে এরা ১০ থেকে ১৪ বছর বাঁচে। তবে বন্দি অবস্থায় আয়ু ১৮-১৯ বছর।

>> বাঘিনী ২-৩ বছর পর পর এক সাথে দুই থেকে তিনটি বাচ্চা দেয়। বাচ্চারা মায়ের সাথে থাকে দুই বছর।

>> তিন প্রজাতির বাঘ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যে ১৩টি দেশে বাঘ টিকে আছে সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস ও রাশিয়া।

বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অঞ্চলের বন সংরক্ষক অসিত রঞ্জন পাল বলেন, বাঘ রক্ষায় সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। শুক্রবার বিশ্ব বাঘ দিবস উপলক্ষে অগাস্টের শুরুতেও নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি নয়াদিল্লীতে সুন্দরবন বিষয়ক আন্তর্জাতিক এক অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বাঘ রক্ষায় দুই দেশই প্রয়োজনীয় তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করছে। ওই অনুষ্ঠানে আমরা বলেছি- বাঘ রক্ষা করতে হলে সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে সবার।”

এদিকে সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাগেরহাটের রামপালে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে তাতে বন ও বাঘের ক্ষতি হবে বলেও শঙ্কা রয়েছে পরিবেশবাদীদের একটি অংশের।  

সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, সুন্দরবনের এত কাছে এই কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে তা থেকে বিষাক্ত গ্যাস ও রাসায়নিক বর্জ্যে ‘নিশ্চিতভাবেই’ সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তজনিত সঙ্কেটে ধ্বংসলীলার চারণভূমিতে পরিণত হবে।

অবশ্য প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুছ আলীর বিশ্বাস, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনে কোনো ‘নেতিবাচক’ প্রভাব পড়বে না।

“যারা রামপাল সম্পর্কে মন্তব্য করে তারা গভীরে যায় না, তাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ইউনেস্কোর ‘রিয়েকটিভ মনিটরিং মিশন’ প্রতিনিধি দলও রামপালের বিষয়ে কোনো বিরূপ মতামত দেয়নি।”

বাঘ নিয়ে পরিসংখ্যান উড়িয়ে দিলেন বনমন্ত্রী

‘বাঘ রক্ষায় তৎপর হওয়া চাই এখনই’

‘প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে বাঘ শিকারী ও পাচারকারীরা’

বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়ে সংশয়

পশু চিকিৎসকহীন সুন্দরবন

সুন্দরবনের ‘ঝুঁকি’ দেখতে মার্চে আসছে ইউনেস্কো দল

কিছু ক্ষতি হলেও রামপাল সরবে না: অর্থমন্ত্রী

রামপালে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি

চুক্তি বাতিল করে রামপাল থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরানোর দাবি