২০% এলাকার ২ লাখ পরিবার বানভাসী

জুলাইয়ের শেষে এসে অতিবৃষ্টি ও উজানে ঢলে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2016, 12:59 PM
Updated : 25 July 2016, 01:12 PM

এই বন্যাকে স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা। সামনে কিছুটা অবনতি ঘটলেও গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র একসঙ্গে ফুঁসে না উঠায় বন্যা ভয়াবহ রূপ নেবে না বলেও ধারণা করছেন তারা।

উজানে টানা সপ্তাখানেকের ভারিবৃষ্টিতে ইতোমধ্যে অন্তত ১২টি জেলার নিচু এলাকা এখন বন্যাকবলিত। এর আয়তন বাংলাদেশের মোট আয়তনের ২০ থেকে ২২ শতাংশ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা সংলগ্ন নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ; গঙ্গা-পদ্মা সংলগ্ন রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর এবং সুরমা-কুশিয়ারা সংলগ্ন সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১০টি জেলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। এতে প্রায় দুই লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত বলে উঠে এসেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী রিপন কর্মকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিবছর জুলাই-আগস্ট মাসে ভারিবর্ষণের সঙ্গে পাহাড়ি ঢলে গড়ে ২০-২৫ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। এ সময়ে স্বাভাবিক মৌসুমী বন্যা এমনই হয়।

“এবারও স্বাভাবিক বন্যা চলছে। মধ্য অগাস্ট পর্যন্ত দেশে ও উজানে ধারাবাহিক বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। এখনও এমন আশঙ্কা দেখছি না আমরা। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র একসঙ্গে ফুঁসে উঠলেই ভয়াবহ রূপ নেওয়ার শঙ্কা থাকে।”

সর্বশেষ ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।

২০১৩ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতে মাত্র ১০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। গত বছরও প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা বন্যা কবলিত হয় বলে জানান বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য।

গত কয়েক দশকে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে, তখন ৬৮ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় ৬১ শতাংশ এলাকা।

বন্যার সঙ্গে ভাঙনও, সিরাজগঞ্জের চিত্র

প্রকৌশলী রিপন কর্মকার বলেন, “অগাস্টের বৃষ্টিতেই বন্যার ভয়াবহ রূপ দেখা দেয়; এক্ষেত্রে উজানে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা অববাহিকায় দীর্ঘদিন ভারিবর্ষণও হয়। ১৯৮৮ সালে একসঙ্গে ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা ফুঁসে উঠেছিল।”

সোমবার থেকে উজানে বৃষ্টি কমেছে বলে জানান তিনি। তিস্তার উজানে দুপুর থেকে পানি কমছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রেও বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক।

আরও এক সপ্তাহ বৃষ্টি বাড়লে অগাস্টের দিকে নতুন করে পূর্বাভাসের পরিকল্পনা রয়েছে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের।

“দীর্ঘদিন পানিবন্দি অবস্থায় থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। এজন্য আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি,” বলেন রিপন কর্মকার।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের জরুরি সাড়াদান কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ছালেহ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, চলতি মৌসুমের স্বাভাবিক বন্যায় ইতোমধ্যে অন্তত একডজন জেলার প্রায় দুই লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্লাবিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

তিনি জানান, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুড়িগ্রামে। লালমনিরহাটে সাত শতাধিক ও গাইবান্ধায় নদীগর্ভে বিলীন সাড়ে ছয়শ’ ঘরবাড়ি।

“আমরা সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত। অতীতেও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তা মোকাবেলা করব,” বলেন ছালেহ উদ্দিন।

ক্ষয়ক্ষতি

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানায়, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর তীরের ৫টি উপজেলার চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সদর, চৌহালী, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও কাজিপুর উপজেলার ২৮ টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ২,৮০০টি পরিবার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বন্যার পানিতে জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের রামভদ্রা বেড়ি বাঁধ ভেঙে ইসলামপুর উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এর ফলে জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার ৭টি, দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ২টিসহ মোট ৯টি ইউনিয়নের ৩,৫৫০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৪০টি ঘর-বাড়ি সম্পূর্ণ এবং ৫০০টি ঘর-বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বন্যা উপদ্রুত কুড়িগ্রাম

কুড়িগ্রামে পানি বেড়ে ৯টি উপজেলার ৫৩টি ইউনিয়নের ১,১০,৪৭৬ টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদী ভাঙনে ৫,৬৩০টি ঘর-বাড়ি সম্পূর্ণ এবং ৩৯,৯৪৩টি ঘর-বাড়ী আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ, সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার ২৭টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত। সদরে ৫,৫০০টি, সুন্দরগঞ্জে ৮,০৭২টি, সাঘাটায় ৭,৭০০টি ও ফুলছড়িতে ৫,২৮২টি পরিবারসহ সর্বমোট ২৬,৫৫৪টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। নদীগর্ভে ৬৫০টি ঘর-বাড়ি বিলীন হয়ে যায়।

লালমনিরহাটে ৫টি উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের ২৮,৬৯৮টি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৪টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আদিতমারীতে ৩,৩০০টি, সদরে ১১,৪০০টি, কালিগঞ্জে ১,৯০০টি, পাটগ্রামে ৫০৮টি ও হাতিবান্ধায় ১১,৫৯০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া মোট ৭২০টি পরিবার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

নীলফামারী জেলার ২টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর মধ্যে ডিমলার ৬টি ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের ৩৮৮টি সম্পূর্ণ ঘর-বাড়ী ও আংশিক ৪,১৯৬টি ঘর-বাড়ী আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং জলঢাকা উপজেলার ২টি উপজেলার ৩টি গ্রামের ১,০৫০টি ঘর-বাড়ী আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

সুনামগঞ্জ জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে ৮টি উপজেলার ৪৯টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ৪৯টি ইউনিয়নের ২০,০০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

ফরিদপুর জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৩টি উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে ৩টি উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ১৬,৯৮০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রংপুর জেলার ৮টি উপজেলার মধ্যে ৩টি উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ১,৪১০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে কাউনিয়ায় ১১টি, গংগাচরায় ৫৬টি, পীরগাছায় ৪২টিসহ মোট ১০৯টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত।

কেন্দ্রের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ (সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত) অনুযায়ী, নদীগুলোর ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে ১৭টিতে পানি বিপদসীমার ওপরে বইছে। উজানে আরও দুদিন বৃষ্টি থাকতে পারে। এর প্রভাবে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদী সংলগ্ন জেলায় অন্তত তিনদিন পানি বাড়বে, এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের জরুরি সাড়াদান কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছালেহ উদ্দিন বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিকভাবে বিতরণের জন্য খাদ্যশস্য, জিআর চাল, জিআর ক্যাশ বিতরণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবহন ও উদ্ধারের জন্য চাহিদা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রয়োজনীয় ওষুধসহ অন্যান্য সামগ্রীও সরবরাহ করা হচ্ছে।