গুলশান সঙ্কট: ঘটনাপ্রবাহ

ঢাকার কূটনৈতিকপাড়া গুলশানের একটি ক্যাফেতে অস্ত্রধারীদের হামলার পর জিম্মি সঙ্কট তৈরি হয়েছে, নিহত হয়েছেন অন্তত দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2016, 08:18 PM
Updated : 31 July 2016, 06:43 PM

সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক জঙ্গি কায়দায় হামলায় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক, ব্লগার, প্রকাশক; ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ভিন্ন মতাবলম্বীরা নিহত হলেও কূটনৈতিক এলাকার কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে এ ধরনের হামলা ও জিম্মি সঙ্কট এই প্রথম।

অভিজাত এলাকায় হলি আর্টিজান বেকারি নামের ওই ক্যাফের সড়কেই কাতার ও রাশিয়ার দূতাবাস; পরের রাস্তায় নর্ডিক ক্লাব।

উৎকণ্ঠার এই নয় ঘণ্টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অপরাধ বিষয়ক প্রধান প্রতিবেদক লিটন হায়দার, প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় বাসিন্দা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে যেসব তথ্য জানা গেছে তা এরকম।

# ঘটনার শুরু শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে  গুলশান ২ নম্বরের কাছে ৭৯ নম্বর রোডের হলি আর্টিজান বেকারিতে, যার মালিক একজন স্প্যানিশ নাগরিক বলে র‌্যাবের তথ্য।

# বেকারির সুপারভাইজার সুমন রেজা জানান, আট থেকে ১০ জন যুবক হঠাৎ সেখানে ঢুকে পড়ে; তাদের একজনের হাতে তলোয়ার এবং বাকিদের কাছে ‘ছোট আকারের বড় ম্যাগাজিনের’ আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।

# হামলাকারীরা আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে ভেতরে ঢোকে এবং  ফাঁকা গুলি শুরু করে। তখন ভেতরে জনা বিশেক অতিথি ছিলেন, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশি।

# ওই বেকারির কয়েকশ গজ দূরে এক বাসা থেকে স্থানীয় এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, তিনিও তার ঘর থেকে  আল্লাহু আকবর ধ্বনি এবং গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছেন।

# সুমন বলেন, হামলাকারীরা ১০-১২টি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর তিনি নিজে ও আর্টিজানের আরেকজন কর্মী দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন।

# ভেতরে থাকা সহকর্মীদের ফোন করার চেষ্টা করলেও তারা ধরছেন না বলে জানিয়েছেন সুপারভাইজার সুমন।

# প্রায় আধা ঘণ্টা পর সেখানে পুলিশ উপস্থিত হয় এবং অসংখ্য গুলির শব্দ পাওয়া যায়। পুলিশ ওই বেকারিতে ঢোকার চেষ্টা করলে ভেতর থেকে গ্রেনেড ছোড়া হয় বলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন।

# ৭৯ নম্বর রোডের শেষ মাথায় ২০ নম্বর বাড়ির এক বাসিন্দা রাত ১০টার দিকে টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পুলিশ নিচ থেকে লাউড স্পিকারে বলছে, উপরে কেউ থাকলে যেন বেরিয়ে আসে। তার সন্দেহ, হামলাকারীদের কেউ হয়তো ওই বাড়িতে ঢুকে লুকানোর চেষ্টা করছে। 

# ওই বাড়ির জানালা দিয়ে উল্টো দিকের রাস্তায় আহত অবস্থায় পুলিশের পোশাক ও হেলমেটধারী একজনকে পড়ে থাকতে দেখার কথাও জানান তিনি।

# ওই বেকারি ঘিরে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের মধ্যে পুলিশসহ আরও অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন।

# বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিনকে গুরুতর আহত অবস্থায় ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন চিকিৎসকরা। পরে আর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামও একই হাসপাতালে মারা যান।

# পুলিশের কনস্টেবল আলমগীর ও প্রদীপ এবং গাড়িচালক আবদুর রাজ্জাক রানাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এসআই বাচ্চু মিয়া।

# রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে ওই বেকারিতে অস্ত্রধারীরা পরপর দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।কিছু সময় পরপর সেখান থেকে গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

# ওই বিস্ফোরণের পর রাত ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে র্্যাবের ‌মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “সেখানে কিছু অস্ত্রধারী প্রবেশ করেছে। এইটাই আমাদের কাছে খবর। সেই রেস্তোরাঁর কিছু কর্মচারী বের হয়ে এসেছে। তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এখন আমরা চেষ্টা করছি, যাতে শান্তিপূর্ণভাবে এটা কিছু করা যায়।”

# ঠিক কতজন সেখানে আটক পড়েছেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি বেনজীর। তিনি বলেন, “আমরা চেষ্টা করব, যারা ভেতরে আছেন, যারা খেতে এসেছিলেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তা অবশ্যই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিপথগামী যারা ভেতরে আছেন, তাদের সঙ্গেও আমরা কথা বলতে চাই।”

# বিভ্রান্তিকর খবর এড়াতে এবং আতঙ্ক সৃষ্টি ঠেকাতে টেলিভিশনগুলোকে গুলশান সঙ্কট সরাসরি সম্প্রচার না করতে অনুরোধ করেন তিনি। এরপর টেলিভিশনগুলো ওই রাস্তায় সরাসরি সম্প্রচার থেকে সরে যায়।  

# তবে জিম্মি সঙ্কটের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর সারা বিশ্বের নজর নিবদ্ধ হয় গুলশানের দিকে। বিবিসি, সিএসএনসহ বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো টেলিভিশন ও ওযেবসাইটে নিয়মিত ঢাকার খবরের আপডেট দিতে থাকে।     

জিম্মি কারা

হলি আর্টিজান বেকারিতে কতজন আটকা পড়েছেন তার নিশ্চিত সংখ্যা জানা না গেলেও উৎকণ্ঠা নিয়ে বেশ কয়েকজন স্বজন উপস্থিত হয়েছেন ঘটনাস্থলে। তাদের মাধ্যমেই জানা গেছে কয়েকজনের নাম।

>> এলিগেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান রুবা আহমেদের মেয়ে অবনিতা কবীর (১৮) ও তার দুই বান্ধবী।

>> ট্রান্সকম গ্রুপের কর্ণধার লতিফুর রহমানের নাতি ফাইয়াজ (২১)।

>> আফতাব গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার খানের ছেলে তাহমীদ (২২) ও তার কয়েকজন বন্ধু।

>> হলি আর্টিজান বেকারির কর্মচারী ইমাম হোসেন সবুজসহ আরও কয়েকজন।

>> জিম্মিদের মধ্যে অন্তত সাতজন ইতালীয় ব্যবসায়ী রয়েছেন বলে ধারণা করছে ঢাকার ইতালিয়ান দূতাবাস।

# গুলশান ২ নম্বর সার্কেলের দিকে যাওয়ার পথে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা আটকে দেওয়া হয় হামলার পরপরই। গুলশান-১ নম্বরে চেকপোস্টে দায়িত্বরত এএসআই এরশাদ বলেছেন, ‘কোনো অপরাধী যাতে পালাতে না পারে’, সেজন্য এই ব্যবস্থা।

# আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা কড়াকড়ির ফলে ঢাকার অভিজাত ওই এলাকার বাসিন্দাদের পাশাপাশি আশপাশের বিপণিবিতান ও রেস্তোরাঁয় আসা লোকজন ও তাদের স্বজনরা ভোগান্তিতে পড়েন। তাদের বাড়ি ফিরতে হয় উৎকণ্ঠার মধ্যে।

# মধ্যরাতের পর থেকে গুলি ও বিস্ফোরণের ঘটনা কমে আসে এবং পরিস্থিতি থমথমে হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে রাত ১টার পর থেকে কমাণ্ডো অভিযানের প্রস্তুতির আঁচ পাওয়া যেতে থাকে বলে ঘটনাস্থল থেকে জানান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অপরাধ বিষয়ক প্রধান প্রতিবেদক লিটন হায়দার।

# রাত ১টার দিকেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন নৌবাহিনীর একটি কমান্ডো দল;সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধি দলকেও দেখা যায়।

# এক পর্যায়ে ৭৯ নম্বর সড়কের মোড়ে পুলিশের কয়েকটি সাঁজোয়া যান এনে রাখা হয়। অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি প্রস্তুত রাখা হয় ফায়ার সার্ভিস এবং বিদ্যুৎ বিভাগের গাড়ি।

# প্রস্তুতির মধ্যেই অভিযানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক, র‌্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদসহ বিভিন্ন বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা কয়েক ঘণ্টা সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন বলে একটি সূত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক সুমন মাহবুবকে নিশ্চিত করেন।

# ওই বৈঠক শেষে পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ফেরার পর ভোর ৫টার দিকে হ্যান্ড মাইকে সাধারণ পোশাকের সবাইকে সেখান থেকে সরে যেতে বলা হয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা সাদা পোশাকে সেখানে আছেন, তাদের সবাইকে বাহিনীর ভেস্ট পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়।

# ভোরের মেঘলা আকাশে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা ওই ভবনের আশপাশের পুরো এলাকা ঘিরে অবস্থান নেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা ব্যর্থ হলে এবং কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিলে যে কোনো সময় অভিযান শুরু হতে পারে বলে লিটন হায়দারের ধারণা।