সাইফুল্লাহ ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী: পুলিশ

মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় তার বিভাগীয় প্রধানের ছেলেকে ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।  

লিটন হায়দার কামাল তালুকদার ও রিপনচন্দ্র মল্লিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2016, 02:57 PM
Updated : 1 July 2016, 03:19 PM

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট বলছে, খালিদ সাইফুল্লাহ নামের ওই তরুণ জেএমবির একজন সক্রিয় সদস্য। তার মোবাইল ফোনে ‘হত্যা পরিকল্পনার নামহীন একটি তালিকাও’ পাওয়া গেছে। 

ওই ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “খালিদ সাইফুল্লাহ কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যাচেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে শুধু কাজ করেনি, এর অর্থদাতাও সে।”

মনিরুলের ভাষায়, ২২ বছর বয়সী এই তরুণ ‘ভ্রান্ত মতবাদে’ বিশ্বাসী।

পুলিশ বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার ডেমরায় মাতুয়াইলের বাদশামিয়া রোড থেকে খালিদকে গ্রেপ্তারের কথা বললেও পরিবারের অভিযোগ, গত সোমবার মাদারীপুরের গোপালপুর থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান বলছেন, গ্রেপ্তারের সময় খালিদের কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়, যার একটি ঢাকার কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমের।

মাদারীপুরে সরকারি নাজিম উদ্দিন কলেজের গণিতের প্রভাষক রিপনকে গত ১৫ জুন কুপিয়ে হত্যার চেষ্টার সময় জনতার হাতে আটক হন ফাহিম। তিন দিন পর পুলিশ রিমান্ডে থাকা অবস্থায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে তার মৃত্যু হয়।

পুলিশ বলছে, শিক্ষক রিপনকে হত্যাচেষ্টার সময় ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন খালিদ।

ফরিদপুর মার্কাজ মাদ্রাসা থেকে কোরআনে হাফেজ হওয়া খালিদ এবারের রমজানে মাদারীপুরে ডাসার থানার গোপালপুর বড় মসজিদে তারাবির নামাজ পড়াতেন।

খালিদের বাবা কাজী বেলায়েত হোসেন সরকারি নাজিম উদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান; এই কলেজেই গণিতের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তী। বেলায়েত অধ্যাপনার পাশাপাশি তাবলিগ জামায়াতেও আসা-যাওয়া করেন বলে স্থানীয়দের তথ্য।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বেলায়েত একবার অসুস্থ হলে রিপন চক্রবর্তী তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। তখনই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ‘জেএমবি সদস্য’ সাইফুল্লাহ।

“...তখনই তার (খালিদ) মাথায় আসে যে, তারা যাদেরকে টার্গেট করছে- সেরকম একজন টার্গেট পরিচিতির ভেতরে এবং হাতের কাছে আছে। তখনই রিপন চক্রবর্তীকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

“রিপন খালেদকে চিনতো বিধায় ঘটনার সময় সে ঘটনারস্থল থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল।”

খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে জামিল ওরফে আফিফ কাইফি ওরফে পথভোলা পথিক নামে এই ‘জেএমবি সদস্যের’ বেশ কয়েকটি নাম থাকার কথা জানান কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল।

যাদের হত্যা করা হবে তার একটি তালিকা খালিদ সাইফুল্লাহর মোবাইলে পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “সংখ্যালঘু, পুলিশ, শিয়া, আহমেদিয়া, পীর-মাশায়েক, খাদেমদের টার্গেট করা ছিল। তবে কারো নাম উল্লেখ নাই।”

আটকের পর খালিদের বিরুদ্ধে ডেমরা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা হয়েছে জানিয়ে মনিরুল বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জেএমবির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করার কথা স্বীকার করেছে সাইফুল্লাহ।

ডেমরা থানার মামলায় খালিদকে ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিনের হেফাজতে পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

যা আছে মোবাইলে

মনিরুল ইসলাম বলেন, “খালিদ তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে উগ্র ধর্মীয় মতবাদ প্রচার ও দেশের বিভিন্নস্থানে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করতো।”

কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার তিনদিন আগে ১২ জুন খালিদ ‘টেলিগ্রাম’ নামে একটি অনলাইন অ্যাপসের মাধ্যমে তাদের গ্রুপের দলনেতা কথিত আমিরের কাছ থেকে অনুমতি নেয় বলে জানান তিনি।

তার পর ১৫ জুন কথিত আমিরের পাঠানো প্রিন্স ফাইজুল্লাহ ফাহিমসহ আরও তিন/চার জন সহযোগী সদস্য ওই শিক্ষকের বাড়িতে হামলা করে।

পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুলের ভাষ্য, অপারেশনে অংশ নেওয়া ফাহিম তার মোবাইল সেটটি খালিদ সাইফুল্লার কাছে রাখতে দিয়েছিল। ঘটনার পরপরই স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়ে ফাহিম; অবস্থা বেগতিক দেখে তার মোবাইল ফোনটি নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় খালিদ।

মনিরুলের দাবি, খালিদ সাইফুল্লার কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইল ফোনে ‘টেলিগ্রাম’ অ্যাপসে কথিত আমিরের সঙ্গে মেসেজ ও ভয়েজ আদান-প্রদান এবং ওই হামলার পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গেছে।

রিপন চক্রবর্তী হত্যা প্রচেষ্টার পর রমজানে আরও একটি ঘটনা ঘটানোর জন্য খালিদ ঢাকায় এসে অন্য সহযোগীদের সঙ্গে পরিকল্পনা করছিল বলে সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়।

‘মগজ ধোলাই’

রিপন হত্যাচেষ্টায় ব্যবহার করা চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল ও চাকু খালিদ নিজে মাদারীপুরের পুরান বাজার কামারপট্টি থেকে কিনে হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের দেয় বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, দুটি চাপাতি, একটি চায়নিজ কুড়াল ও একটি চাকু কিনতে দুই হাজার সাত থেকে দুই হাজার আটশ টাকা খরচ করার কথা জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল্লাহ স্বীকার করেছে।

“এই ঘটনায় ব্যবহৃত চাপাতি সে কিনে দেয়; চায়নিজ কুড়াল ও চাকু মাদারীপুরের পুরান বাজার কামারপট্টি থেকে সে নিজে কিনে হত্যায় যারা সরাসরি অংশ নিয়েছে তাদের দেয়। কেনার পরে সে বলে সাতাইশশ-আটাইশশ (২৭০০-২৮০০) টাকা খরচ হল।”

মনিরুল বলেন, “তার (সাইফুল্লাহ) বক্তব্য ছিল, ‘সাতাইশ/আটাইশশ টাকা খরচ করলাম- আখেরাতে এবং গনিমতের মাল হিসেবে এর চেয়ে অনেক বেশি আল্লাহ বরকত দেবেন’। এরা ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী। বাচ্চা ছেলে… ব্রেইন ধোলাই করা হয়েছে, এজন্য বিভ্রান্ত বা পথভ্রষ্ট হয়েছে।”

যুবকদের বিপথে যাওয়া ঠেকাতে অভিভাবক, শিক্ষক, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এই প্রধান।

“যুবক সমাজ যেন পথভ্রান্ত হয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হয়, সেদিকে সবাইকে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমরা মনে করি সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জঙ্গিদেরকে উৎখাত করা সম্ভব হবে।”

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলো কারো মদদ পাচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নে মনিরুল বলেন, “জঙ্গিরা সরকারকে উচ্ছেদ করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দখলের চেষ্টা করে। তারা টার্গেট করে হিন্দুদের মারলে ভারত খেপবে। অন্যদের মারলে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ খেপবে এবং বাংলাদেশর উপর থেকে তাদের আস্থা হারাবে।”

কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যাচেষ্টার ‘মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জেএমবি সদস্য’ খালিদ সাইফুল্লাহকে ঢাকায় আটকের পর তার মাদারীপুরের বাসায় তল্লাশি চালায় পুলিশ।

মাদারীপুরে বাসায় তল্লাশি

কলেজশিক্ষক রিপন হত্যাচেষ্টায় ঢাকা থেকে আটকের পর খালেদ সাইফুল্লাহর মাদারীপুর শহরের গোলাবাড়ী এলাকার বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ।

শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে এই তল্লাশি চালায় মাদারীপুর সদর থানা পুলিশ।

এদিকে পুলিশ ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে খালিদ সাইফুল্লাহকে আটকের কথা বললেও তাকে গত ২৭ জুন রাতে মাদারীপুরের ডাসার থানার গোপালপুর বড় মসজিদ থেকে সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে আটক করা হয় বলে দাবি করেছে তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন।

নাম প্রকাশ না করে সাইফুল্লাহর ফুফাতো বোন পরিচয় দেওয়া এক নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বলছেন, গত সোমবার (২৭ জুন) রাতে গোপালপুর বড় মসজিদ থেকে সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে সাইফুল্লাহকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। 

এরপর ছেলেকে খুঁজতে বের হয়ে তার বাবা বেলায়েত হোসেনও নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করেন খালিদের মা নাজমা আক্তারসহ তার স্বজনেরা।

এসব অভিযোগের বিষয়ে মাদারীপুর থানার পুলিশের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তবে খালিদকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এর আগে তা অস্বীকার করে আসছিলেন মাদারীপুর সদর থানার ওসি জিয়াউল মোর্শেদ।