হারানো ছেলের অপেক্ষায় এক শ্রমিক দম্পতি

রাজধানীর আদাবরের সুনিবিড় হাউজিংয়ের সড়ক নির্মাণ শ্রমিক দম্পতি রুক্কু হাওলাদার আর ডলি বেগমের সাতবছরের ছেলে রাসেলের খোঁজ নেই এক বছরের বেশি সময়। থানা পুলিশ, এলাকার মুরব্বি থেকে শুরু করে আদালতে গিয়েও ছেলের হদিস পাননি তারা।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2016, 10:48 AM
Updated : 30 June 2016, 11:38 AM

তাদের অভিযোগ, পারিবারিক শত্রুতার জের ধরে গত বছরের ১৭ মে প্রতিবেশী ক্ষৌরকার বাদল বাবুর ১৫ বছরের ছেলে ‘কুড়ানি দলের নেতা’ নয়ন ‘ফুসলিয়ে’ রাসেলকে দলে টেনে ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ নিয়ে ‘গায়েব বা পাচার করে’ দেয়। এরপর ঢাকায় ফিরে রাসেল হারিয়ে গেছে বলে ‘গল্প সাজায়’। বিষয়টি নিয়ে আদাবর থানা ও ‘এলাকার নেতাদের’ কাছে গিয়েও ‘পাত্তা পাননি’, কারণ নয়নের কাকা উজ্জ্বল ‘থানার সোর্স’ ও ‘ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত’।

রুক্কু ও ডলি জানান, রাসেলকে পেতে আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় মাইকিংয়ের পাশাপাশি পোস্টারিং করেছেন। কয়েক দফা মানিকগঞ্জ গিয়েছেন। পরে এলাকার কয়েকজনের পরামর্শে আদাবর থানা পুলিশকে কিছু টাকা-পয়সাও দেন। কিন্তু ছেলেকে পাননি।

দিনমজুর এই দম্পতির অভিযোগ, পুলিশ মামলা না নিয়ে অভিযোগ সাধারণ ডায়েরি আকারে নেয় এবং তাদেরকে সহানুভূতি না দেখিয়ে উল্টো নয়নের পরিবারের ‘পক্ষ নেয়’। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তারা আদালতে যান মামলা করতে।

মানব পাচার আইনের ওই মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এসআই জিন্নাতুল ইসলাম তালুকদার বলেছেন, তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন মাস দেড়েক আগে; চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ঘটনার রহস্য বের করতে।

বাক আর শ্রবণ প্রতিবন্ধী রুক্কু ও তার স্ত্রী ডলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, নয়ন তার বাবা-মায়ের ‘কুপরামর্শে’ রাসেলকে ‘গায়েব’ করে দিয়েছে। হয়তো তাকে কোনো ভাঙ্গারির দোকান অথবা কারও বাসা-বাড়িতে কায়িক শ্রমে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছেল

পরিবারকে না জানিয়ে কোনো শিশুকে সরিয়ে নিয়ে কায়িক শ্রমে লাগানো মানব পাচার আইনে অপরাধ।

এই শ্রমিক দম্পতি বলছেন, রাসেল নিখোঁজ হওয়ার পর তারা জিডি করেন। এরপরও চলে খোঁজাখুঁজি আর পুলিশের কাছে ‘আবেদন-নিবেদন’। তাতেও দিশা না পেয়ে বাধ্য হয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ৪ নম্বর মানব পাচার ট্রাইব্যুনালে মামলার আবেদন করেন ডলি। বিচারক সালেহ উদ্দিন আদাবর থানার ওসিকে মামলাটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দেন।

মানব পাচার আইন অনুযায়ী, এ ধরনের মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলায় কাগজ আর ভাঙ্গারি কুড়ানি দলের কয়েকটি শিশু ও এলাকার কয়েকজন ‘মুরুব্বিকে’ সাক্ষী করা হয়। আসামি করা হয় বাদল বাবু (৫০), তার ছেলে নয়ন (১৫), স্ত্রী শিমুলী (৪৫), বাদলের ভাই উজ্জ্বল বাবুকে (৩৫)।

আরজিতে বলা হয়, রুক্কুর ছেলেকে বাদলের ছেলে ‘ফুসলিয়ে দলে টেনে’ ঘটনা ঘটিয়ে বাড়ি ফিরে ‘কোনো সন্তোষজনক’ উত্তর দিতে পারে নাই। বাদল আর নয়নকে নিয়ে রুক্কু তার ছেলেকে মানিকগঞ্জ খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন।

এ মামলায় বাদল, শিমুলী ও নয়নকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকার তৎকালীন মহানগর হাকিম অমিত কুমার দে শিমুলী ওরফে শেফালি ও নয়নকে সেদিনই জামিন দেন। গত বছরের শেষদিকে হাই কোর্ট থেকে জামিন পান বাদল।

রুক্কু ও ডলির অভিযোগ, উজ্জ্বল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় পুলিশ তাকে ধরছে না। মামলা তুলে নিতে কয়েকবার হুমকিও দিয়েছেন উজ্জ্বল।

আসামিদের আইনজীবী এইচ বি শাওন তাদের জামিন আবেদনে বলেন, পাড়ার বখাটে কিছু ছেলে বাদলের দুই মেয়েকে উত্ত্যক্ত করত। তাদের প্ররোচনায় বাদলদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

ডলি টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিআইডি কর্মকর্তা তানভীর মাস তিনেক আগে রুক্কুকে নিয়ে মানিকগঞ্জে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের যে হোটেলে রাসেল ও অন্যরা ভাত খেয়েছিল সেখানে গিয়েছিলেন তদন্তে। পাড়ার কাগজ কুড়ানি আর ভাঙ্গারি সংগ্রহকারী দলের হানু (১২) ও স্বপনকে (১২) নেতৃত্ব দিত নয়ন। তাদেরসহ কয়েকজন সাক্ষীর জবানবন্দিও নিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়নি।

১২টি তারিখ পার হলেও পুলিশ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বা রাসেলকে উদ্ধার করতে পারেনি জানিয়ে বাদীর আইনজীবী সেলিম খান বলেন, “ইতোমধ্যে আইনে নির্ধারিত তদন্তের সীমা ৯০ কার্যদিবস এবং ব্যর্থতায় আরও অতিরিক্ত ৩০ কার্যদিবস পার হয়েছে।

“কিন্তু মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের তদন্তের সময়সীমার তোয়াক্কা না করে তদন্তের সীমা বাড়ানোর জন্য তদন্ত কর্মকর্তা বারবার আদালতে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নিচ্ছেন। আর আদালতও তাদের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছেন।”

২৭ জুলাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমার নতুন তারিখ পড়েছে জানিয়ে বাদীর আইনজীবী বলেন, “ডলি আগে নিয়মিত আদালতে আসতেন। ভাবতেন, আদালত তার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বস্তবতা তো অন্যরকম। ...  হতাশ ডলি আর আদালতে আসেন না। টেলিফোন করেও খোঁজ-খবর নেন না।”

মামলায় তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা জিন্নাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আসামিদের অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে চেয়েছিলেন আগের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই তানভীর কবির। তার বদলে তাকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।

“আদাবরে ডলির কাছে গিয়েছি। তার সঙ্গে কথাও হয়েছে। তদন্ত চলছে,” বলেন তিনি।