যেমন স্কুল চায় শিশুরা

কারও চাওয়া সাজানো গোছানো বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আলোচনা হবে খোলামেলা; কেউবা চায় বড় মাঠ, খেলার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ; কারও চাওয়া বিদ্যালয় ঘিরে নিরাপত্তা বেষ্টনি; কেউবা চায় মাল্টিমিডিয়ায় শিক্ষার সুযোগ।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2016, 01:49 PM
Updated : 29 June 2016, 04:05 PM

‘মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা’ নিয়ে জাতীয় সম্মেলনে বড়দের সামনে নিজেদের স্বপ্নের বিদ্যালয় নিয়ে এমন প্রত্যাশাগুলো উঠে এসেছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের কথায়।

বুধবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে কচি-কাঁচাদের কণ্ঠে তাদের প্রত্যাশার কথা শুনে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিশুরাই তো বলে দিল মানসম্মত শিক্ষা কী?

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ৬৪টি জেলা থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির প্রতিনিধি এবং শিক্ষা কর্মকর্তাসহ ২৫৬ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।

বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার কথাও বলেন। মতামত দেন, কীভাবে তা নিরসন করে গড়ে উঠতে পারে তাদের স্বপ্নের বিদ্যালয়।

সিলেটের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মনিষা রায় অমি বলেন, “আমার স্বপ্নের স্কুল হবে সাজানো গোছানো।

“শিক্ষকরা হবে বন্ধুর মতো, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করবেন। কোনো পড়া বুঝতে না পারলে তা নির্ভয়ে তা শিক্ষকদের জানাতে পারব। স্কুলে থাকবে সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ।”

লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলা করার জন্য পর্যাপ্ত সময় চেয়েছেন পঞ্চগড়ের ২ নম্বর পঞ্চগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী নিশাত জান্নাত ছোটন।

“সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সোয়া ৪টা পর্যন্ত স্কুল। মধ্যে আধা ঘণ্টার বিরতি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর আর খেলাধুলার সময় থাকে না। স্কুলের সময়টা এমনভাবে করেন যেন আমরা খেলতে পারি।”

পিরোজপুর সদরের পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দিবা দেবনাথ দেশের সবগুলো স্কুলে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ চান।

“মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পড়ানো হলে তা সহজেই বুঝতাম। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ থাকলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশবিদেশের সব তথ্য জানা আমাদের জন্য আরো সহজ হত।”

নিরাপত্তার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন চাঁদপুরের ৫৬ নম্বর খলিশাডুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিফরিন হৃদিতা।

“আমাদের স্কুলে কোনো নিরাপত্তা দেয়াল নেই। ফলে বখাটে ছেলেরা স্কুলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের বিরক্ত করে।”

গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার একটি স্কুলের শিক্ষার্থী অর্পণ স্কুলে ‘মিড-ডে মিলে’ দেওয়া বিস্কুট ভালো না লাগার কথা অকপটে জানান।

“এই বিস্কুট বেশি ভালো না। প্রতিদিন এক প্যাকেট দেয়।”

তাদের মতামত শুনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিশুরা তাদের চাওয়ার যে তালিকা দিয়েছে, তা-ই মানসম্মত শিক্ষা।

“আমরা তো মানসম্মত শিক্ষা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তার জন্য বিশাল সম্মেলন করছি। শিশুরাই তো আমাদের বলে দিল মানসম্মত শিক্ষা কী? আমরা যদি আজকে শিশুদের কথাগুলোর তালিকা তৈরি করি, তাহলেই মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হবে। এজন্য কনসালটেন্ট লাগবে না, টাকা লাগবে না।”

“শুধু শিখলে হবে না। যে শিক্ষা আমরা বুকের মধ্যে ধারণ করতে পারি তাই মানসম্মত শিক্ষা,” বলেন তিনি।

অনুষ্ঠানে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষায় বাধা এবং তা দূর করার ক্ষেত্রে করণীয় নিয়ে পরামর্শ দেন শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা।

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার গাড়াডোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক তরিফা নাজনীনা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় জোর এবং দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের হাতে বই তুলে না দেওয়ার সুপারিশ করেন।

“আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে সরাসরি বই তুলে না দিয়ে জুতোর ফিতা বাঁধা, পরিচ্ছন্নতা, আচরণ- এমন জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা দিতে পারি। সেসব বিষয়ের মূল্যায়ন করে তাদের তৃতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা যায়।”

স্কুল থেকে শিশুদের ঝরে পড়া রোধে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কারিগরী শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি।

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান শিক্ষার্থীদের স্বপ্নবান করে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের কাজের উপর জোর দেন।

“শিক্ষক হবেন বন্ধুর মতো। তিনি পড়াবেন, আমাকে স্বপ্ন দেখাবেন। আবার স্বপ্ন বাস্তবায়নে পথ দেখাবেন।”

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বুধবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা’ শীর্ষক জাতীয় সম্মেলনে অতিথিরা। ছবি: নয়ন কুমার

স্কুলের শিক্ষকদের সময়মতো ক্লাসে উপস্থিত থাকা বলে জরুরি মনে করেন খুলনা টুটপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি এসএম মাসুদ মাহমুদ।

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। স্কুলের সময়সূচিতেও পরিবর্তন আনার সুপারিশ তিনি করেন।

“বর্তমান সময়সূচি কমিয়ে সকাল ৮টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত করা উচিৎ। দুপুরের পর শিক্ষার্থীরা ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। স্কুলে থাকতে চায় না, চলে যায়।”

শিক্ষার্থীদের স্কুলে উপস্থিতি বেশি মানেই মানসম্মত শিক্ষা নয় মন্তব্য করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিআরআইর নির্বাহী পরিচালক সাব্বির বিন শামস। শিক্ষার মানোন্নয়নে দাতাদের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমানোর পরামর্শও দেন তিনি।

“শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে দাতাসংস্থার সব পরামর্শ মানা যাবে না। এটা করা হলে কোনোদিন মানসম্মত শিক্ষার লক্ষ্যপূরণ কোনোদিন সম্ভব নয়।”

জাতীয় সম্মেলনে আসা বিভিন্ন পরামর্শ ও মতামত ‘আলোকবর্তিকা’ হিসেবে কাজ করবে মন্তব্য করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার বলেন, আন্তরিকতা দিয়ে সীমিত বাজেটের মধ্যেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।

“সবাই সাজেশন দিচ্ছে খরচ বাড়ানোর জন্য। শিক্ষাখাতের সবাই যদি নিবেদিতপ্রাণ হয় তাহলে সীমিত সুযোগ সুবিধার মধ্যে থেকেই মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। বেশি টাকা বেতন দিলে কি দেশপ্রেম বেশি হবে?”

প্রাথমিক শিক্ষায় যে বরাদ্দ হয়, তাও ঠিকমতো ব্যবহার হয় না বলে জানান প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেন।

“একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বছরে ৪০ হাজার টাকার মেরামত খরচ দেওয়া হয়। কিন্তু সে টাকা প্রধান শিক্ষক, স্কুল কমিটি আর শিক্ষা কর্মকর্তারা খেয়ে ফেলেন।”

প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশও করেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী।

“গরু-ছাগলের জন্যও ক্যাডার সার্ভিস আছে। তাহলে সাড়ে চার লাখ শিক্ষকের জন্য কেন ক্যাডার সার্ভিস থাকবে না?”

এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন খালিদ।