ওয়াসার পানি: থাকা আর না থাকা

ঢাকার এক প্রান্তের মাণ্ডায় ক’দিন পরপরই পাম্প ‘বিকল’ থাকে বলে ওয়াসার লাইনে পানিই আসে না। তবে পাশের মুগদায় সে অভাব নেই; কল খুললেই আসছে দুর্গন্ধময় ময়লা পানি।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2016, 05:54 AM
Updated : 29 June 2016, 05:56 AM

বাসিন্দাদের অভিযোগ, সারা বছরের এই ভোগান্তির কথা ওয়াসাকে জানানো হয়েছে অসংখ্যবার। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাতে ‘কান দিয়েছে’- তেমন প্রমাণ মিলছে না।

ঢাকাবাসীর জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব নেওয়া দপ্তর ওয়াসার কর্মকর্তারা অবশ্য বলেছেন,  দুই এলাকার দুই ধরনের সমস্যা সম্পর্কেই তারা ওয়াকিবহাল। সঙ্কট কাটাতে তাদের  চেষ্টাও ‘অব্যাহত আছে’।

মঙ্গলবার মুগদা ও মাণ্ডা এলাকা ঘুরে ওয়াসার পাম্পগুলোতে সারাদিনই ভিড় দেখা যায়। পানির জন্য অনেকেই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সকাল থেকে, এটাই তাদের প্রতিদিনের রুটিন।

 যাদের পাম্পে দাঁড়ানোর সময় নেই, তাদের নগদ টাকায় ভ্যানওলাদের ‘সেবা’ নিতে হয়। এই ভ্যানওলারাই পাম্প থেকে পানি নিয়ে গ্যালন দরে পৌঁছে দেন বাসায় বাসায়।

“লাইনে যে ময়লা পানি আহে, ফুটাইলেও খাওন যায় না”, বলেন মুগদা আদর্শ গলির বাসিন্দা জুলেখা বেগম। খাওয়ার পানি যোগাড় করতে প্রতিদিন দুইবার করে মুগদা ২ নম্বর পানির পাম্পে যেতে হয় তাকে।

তিনি জানান, তাদের এলাকায় সরবরাহ লাইনে পানির কোনো ‘ঘাটতি নেই’। কিন্তু ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত সে পানি খাওয়া বা রান্না করার অযোগ্য।

তাই তার মত অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন সকাল থেকে বোতল, গ্যালন, জারসহ বিভিন্ন পাত্র নিয়ে পাম্পের সামনে ‘সিরিয়াল’ দিয়ে থাকেন।

“পানি না নিলে উপায় কি? খাইতে, বাসন মাজতে আর গোসল করতে পানি লাগে না? লাইনের ময়লা পানি নিয়া মরুম নাকি”, বলেন জুলেখা।

পাম্পের সামনে কথা হয় আনন্দধারা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা রোকসানা আক্তারের সঙ্গে।

পানির জন্য দীর্ঘসময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এ গৃহিনী জানান, ওয়াসার পানির ভ্যান তাদের গলিতে যেতে পারে না বলে বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে তাকে।

ওয়াসার পাইপে যে পানি আসে তা সরবরাহ লাইনের কারণেই ‘ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত’ হয় বলে জানান মুগদা বিশ্বরোড এলাকার জিএম মোহসিন আলী।

“সরবরাহ লাইন অনেক পুরনো। এজন্য পানির সঙ্গে ময়লা আসে, কেঁচো আসে। আমি নিজের হাতেই কয়েকবার কেঁচো ফেলেছি।”

বৃষ্টি হলে পানিতে ময়লার পরিমাণ আরও বেড়ে যায় বলে জানান দক্ষিণ মুগদাপাড়ার ৪৫ নম্বর বাড়ির গৃহিনী রওশন আরা।

“এ পানি দিয়ে কোনো কাজ করা যায় না। পানি দিয়ে গোসল করলে শরীর চুলকায়, চোখ জ্বালা করে।”

নিজে গিয়ে পাম্প থেকে পানি আনতে পারেন না ওয়াপদা গলির বাসিন্দা শেফালী ঘোষ, তাই প্রতিদিন নিয়ম করে ভ্যানওলার কাছ থেকই পানি কিনতে হয় তাকে।

“বাসার লাইনের পানি মুখে দেওয়া যায় না, বমি আসে। ভ্যানওলাকে ফোন দিলে সে পানি দিয়ে যায়। সেই পানি খাই। কি করব বলেন?”

‘খাওয়ার পানি’ বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য মুগদাপাড়া কমিউনিটি সেন্টার পাম্পে ১০-১২টি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে সারাক্ষণই। এসব ভ্যান উত্তর ও দক্ষিণ মুগদা, মাণ্ডা, ওয়াপদা গলি এমনকি বাসাবো, মানিকনগর এলাকার বিভিন্ন বাসাতেও পানি পৌঁছে দেয় বলে ভ্যানচালক আবু হাসান জানান।

“গ্যালান ভইরা পানি নিয়া বাসায় বাসায় দিয়া আহি। প্রতি গ্যালান পানি ১০ টাকা কইরা নেই।”

দক্ষিণ মুগদার এ বাসিন্দা জানান, তিনি নিজেও বাসার জন্য এখান থেকেই পানি নেন।

  মাণ্ডার বাসিন্দাদেরও এই ভ্যানওলাদের শরণ নিতে হয় পানির জন্য। সারা মাসে বাসার কলে তারা পানির দেখা পান ‘কদাচিৎ’।

রোজার মধ্যে এ সঙ্কট আরও বেড়েছে চারটি পাম্পের একটি বিকল হয়ে যাওয়ায়। রোববার মাণ্ডা ৩ নম্বর পানির পাম্প দিয়ে কাদাপানি উঠতে শুরু করায় কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে পানি তোলা বন্ধ করে দেয়। এরপরই তীব্র ভোগান্তিতে পড়ে দানবের গলি, তাহেন চেয়ারম্যানের গলি, আয়েত আলীর গলি ও টাকিপাড়া গলির লোকজন।

“একদিকে প্রচণ্ড গরম, অন্যদিকে রোজা; এমনিতেই পানি থাকে না, তার উপর পাম্প নষ্ট হয়ে বিপদ বাড়াইছে”, বলেন মাখনবাজারের বাসিন্দা জহিরুল হক বাবুল।

“বাসায় পানি না পেয়ে ভাড়াটিয়ারাও মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। ওয়াসার এক গাড়ি পানির জন্য বলেছি। দেখি কখন দেয়”, বলেন এ উদ্বিগ্ন বাড়িওয়ালা।

একই অবস্থা মাণ্ডা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাসান সাঈদ তাহেনেরও। বাসাবাড়ির পাশাপাশি মসজিদে পানি না থাকায় মুসল্লিদের অসুবিধার কথা ভেবেও চিন্তিত তিনি।

“বাসাবাড়িতে পানি নাই। পানির জন্য মুসল্লীরা মসজিদে এসে ওজুও করতে পারে না। ঝামেলায় আছি।”

বাসিন্দাদের অভিযোগ, আগেও নিয়মিত পানি না থাকার বিষয়টি ওয়াসাকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা। পাম্প বিকল হলে নিত্যদিনের এ সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে।

 ওয়াসা কর্মকর্তারা অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছেন, পানির এ সঙ্কট ‘বেশি দিন থাকবে না’।

নষ্ট হয়ে যাওয়া পাম্পটি ঠিক করতে কাজ শুরুর কথা জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।

“মাণ্ডার পাম্পের বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছি। সমস্যা সামান্য হলে কয়েকদিনেই ঠিক করে দেব। আর প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন পড়লে দেড় মাসের মত সময় লাগতে পারে।”

মুগদার সমস্যা নিরসনেও ‘কাজ চলছে’ জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, “ওই এলাকার সব লাইন পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন করা হবে। একটি প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে।”