বাবুল আক্তারকে নিয়ে দিনভর নাটকীয়তা

গভীর রাতে ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য’ ঢাকার শ্বশুরবাড়ি থেকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়ার ১৪ ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরেছেন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার, যার স্ত্রী ২০ দিন আগে চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে খুন হন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 June 2016, 10:37 AM
Updated : 26 June 2016, 02:24 AM

শনিবার বিকাল সোয়া ৪টার দিকে টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যার তদন্তের বিষয়ে ‘আলোচনা করতে’ তাকে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। 

এরপর বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বাবুল ঢাকার বনশ্রীতে তার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছান বলে তার বাবা ওয়াদুদ মিয়া জানান।    

শুক্রবার রাত ১টার দিকে ওই বাসা থেকেই ঢাকার পুলিশ সদরদপ্তরে সংযুক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে দুই পুলিশ কর্মকর্তা এসে নিয়ে যান। এরপর থেকে বাবুল বা পুলিশের কোনো বড় কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে স্বজনদের মধ্যে তৈরি হয় সন্দেহ আর উদ্বেগ।

এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, ‘কয়েকজন আসামির সামনে মুখোমুখি করে’ বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমে সেই খবর আসার পর ডালপালা মেলতে শুরু করে নানা গুঞ্জন।

স্ত্রী হত্যার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে- এমন গুঞ্জনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাবুল আক্তার ফোনে পাল্টা প্রশ্ন করেন, “এগুলো কে বলল?”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। যারা তদন্ত করছেন, তারা বিভিন্ন বিষয়ে আমার সাথে আলোচনা করেছেন।”

সারা রাত তাদের এই ‘আলোচনা’ হয়েছে কি না- এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান জঙ্গি দমন অভিযানের জন্য আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা, যাকে সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে পদোন্নতি দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।

বাবুল ঢাকায় যোগ দেওয়ার তিন দিনের মাথায় ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোডের বাসার কাছে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় খুন হন তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু।

মোটর সাইকেলে করে আসা তিন হামলাকারী মিতুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

চট্টগ্রামের পুলিশ বলে আসছিল, গত দুই বছরে চট্টগ্রামে জঙ্গি দমন অভিযানে বাবুলের ভূমিকার কারণে জঙ্গিদেরই সন্দেহের তালিকায় প্রথমে রেখেছেন তারা; সেভাবেই মিতু হত্যার তদন্ত করছেন তারা। 

পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার ও তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু

নাটকীয়তার শুরু মধ্যরাতে

স্ত্রী খুন হওয়ার পর থেকে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় শ্বশুর বাড়িতেই থাকছিলেন এসপি বাবুল আক্তার। তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন অবসরে গিয়েছিলেন পুলিশের ওসি হিসেবে।  আর বাবা আবদুল ওয়াদুদ মিয়াও চাকরি করেছেন পুলিশে।

শুক্রবার রাতে বনশ্রী থেকে যখন বাবুল আক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয়, তার বাবাও তখন ওই বাসায় ছিলেন।

শনিবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাবে একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে যাওয়ার পর বাবুল জানায়, আইজি সাহেবের সাথে দেখা করবে। দেখা করার পর অনুষ্ঠান হয়েই বাসায় আসে ওরা।”

বাবা ও শ্বশুরের ভাষ্য অনুযায়ী,বাবুলের সঙ্গে খিলগাঁও থানার ওসি মঈনুল হোসেনও বনশ্রীর বাসায় যান। কিছুক্ষণ পর যান মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার আনোয়ার হোসেন। তিনিই জানান, পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ‘ডেকেছেন’ বাবুলকে।

কিন্তু তার পর থেকে বাবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় এবং পুলিশ কর্মকর্তারা ‘ফোন না ধরায়’ তাদের মধ্যে শুরু হয় উদ্বেগ।  

ওয়াদুদ মিয়া সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ছেলের সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। আগে ওসি সাহেব একবারেই ফোন ধরতেন, আমাদের নিরাপত্তার খোঁজ খবর নিতেন। এখন ফোনই ধরছেন না। ডিবি অফিসেও যোগাযোগ করেছি, কেউ কোনো সহযোগিতা করছে না; বলছে, উপরের অফিসাররা বলতে পারবে।”

এ বিষয়ে কথা বলতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে খিলগাঁওয়ের ওসি এবং মতিঝিলের উপ কমিশনারকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তারা ধরেননি।

বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলেন, “গভীর রাতেও বাবুল বাড়ি ফিরছিল না। তার মোবাইল ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। এই নিয়ে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। সময় যত বাড়ছিল চিন্তাও বাড়ছিল।

“অনেকে জানতে চেয়েছে বাবুল তার স্ত্রীকে হত্যা করিয়েছে কি না। আমার বক্তব্য জানতে চেয়েছিল অনেকে। আমি বলেছি, আমি কোনোদিন বিশ্বাস করি না বাবুল মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করতে পারে। এটা একেবারেই অসম্ভব।”

তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা এখনও তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি এবং তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে বাবুলও তার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি বলে জানান তিনি। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেন

বাবুল আক্তারকে নিয়ে নানা গুঞ্জনের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তারা ফোন না ধরলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়।

সকালে টেলিফোনে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েকজন আসামির সামনে মুখোমুখি করে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।”

এসপি বাবুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না, বা তাকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এ প্রশ্নে মন্ত্রীর উত্তর, “এখনও বলার সময় হয়নি। শিগগিরই জানতে পারবেন।”

পরে মাদকের অপব্যবহার ও পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে ঢাকা ক্লাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় এ বিষয়ে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “(মিতু হত্যার) ঘটনাটি দুঃখজনক। আমরা কনফিডেন্ট যে তাদের (দোষী) ধরতে সক্ষম হয়েছি।”

বাবুল আক্তারকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বাবুল আক্তার একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ওই এলাকার অনেককেই তিনি চেনেন, যাদের আটক করেছি তাদের কনফার্ম করার জন্য বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি।”

বাবুলের বাড়ি ফেরা

বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন জানান, বিকাল ৪টার পর বাবুল তাকে ফোন করে বলেন ‘আমি রিলিজ হয়েছি। বাড়িতে আসছি।”

পরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক উপ-কমিশনারের গাড়ি তাকে খিলগাঁওয়ের মাদারটেকের ভূঁইয়াপাড়ায় বাসার কাছে নামিয়ে দেয়।

মোশাররফ হোসেন

মোশাররফ হোসেন বলেন, বাবুল তাকে ফোনে বলেন তিনি কোনো মিডিয়ার মুখোমুখি হবেন না। তাকেও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলার অনুরোধ করেছিলেন।

ডিবি কার্যালয়ে কী হয়েছে সে বিষয়ে বাবুল তাদেরও কিছু বলেননি বলে জানান তিনি।

“তার (বাবুল) মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। সারারাত ঘুমায়নি। তাই বাড়িতে ফিরেই ঘুমাতে চলে যায়। সারারাত কোথায় ছিল, কী করেছে, কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, খুনিদের বিষয়ে কিছু জানা গিয়েছে কি না এমনকি কী খেয়েছে তা নিয়ে বাসায় কারও সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।”

বাবুলের বাবা ওয়াদুদ মিয়া জানান, বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তার ছেলে শ্বশুরবাড়ি ফিরে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। 

কারা মিতুকে খুন করেছে, সে বিষয়েও টেলিফোনে বাবুল তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে ওয়াদুদ মিয়ার ভাষ্য। তবে পুলিশের মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব না হওয়ায় সে তথ্য এখানে প্রকাশ করা হল না। 

রাতে যা হয়েছিল: পুলিশের ভাষ্য

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাহবুব আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার এ হত্যা মামলার বিষয়ে বাবুল আক্তারের সাথে কথা বলার জন্য রাতে তার কক্ষটি চেয়ে নেন।

“পরে সিএমপি কমিশনার নিজে বাবুল আক্তারকে ফোন করে সেখানে আসতে বলেন। বাবুল আসার পর তারা প্রায় সারা রাত কথা বলেন।

“বাবুলের কাছে থাকা তথ্য এবং পুলিশের কাছে থাকা তথ্য তারা মিলিয়ে দেখেন এবং মামলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।”

সে সময় সেখানে আইন শৃঙ্খখলা বাহিনীর আরও অন্তত দুইজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন বলে মাহবুব আলমের ভাষ্য।

এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, বাবুল সকাল ৯টার দিকেই শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার কথা বলে ডিবি অফিস থেকে বেরিয়ে যান।

অবশ্য কতক্ষণ ডিবি অফিসে ছিলেন, সেখানে আর কারা ছিল, সেসব বিষয়ে টেলিফোনে কোনো মন্তব্য করেননি বাবুল আক্তার।   

স্ত্রী খুন হওয়ার পর স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার (সামনে মাঝে)।

মিতু হত্যার ঘটনাক্রম

# মিতু হত্যাকাণ্ডের পরদিন ৬ জুন খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটি চট্টগ্রামের বাদুরতলা এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ।

# ওইদিনই বাবুল আক্তার নিজে বাদী হয়ে স্ত্রী খুনের ঘটনায় মামলা করেন। সন্দেহভাজন হিসেবে চারজনকে আটকের কথা জানায় পুলিশ। যদিও তাদের রাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়।

# ৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে আবু নসুর গুন্নু (৪৬) নামের একজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায়, তিনি একজন ‘সাবেক শিবির কর্মী’। মিতু খুনের পর ঘটনাস্থল অতিক্রম করা কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস ও তার চালককে একইদিনে আটক করে পুলিশ।

# ৯ জুন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে হাটহাজারী মুসাবিয়া দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতার উত্তরসূরীদের একপক্ষ দাবি করে ‘মাজার কেন্দ্রিক বিরোধের’ শিকার নসুর।

# ১০ জুন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে এসপিপত্মী খুনের ঘটনায় মানববন্ধন চলাকালে সন্দেহজনক ঘোরাফেরার অভিযোগে ইব্রাহিম (২৬) নামের রিকশাচালক এক যুবককে ছোরাসহ আটক করে পুলিশ।

# ১১ জুন নগরীর বায়েজিদ থানার শীতল ঝর্ণা এলাকা থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন (২৮) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় রাস্তার পাশের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে যে যুবককে অনুসরণ করতে দেখা গিয়েছিল, ওই যুবকই রবিন বলে পুলিশের সন্দেহ।

# ১২ জুন গ্রেপ্তার নসুর ও রবিনকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি পায় পুলিশ। ওইদিন ঘটনা তদন্তে পাঁচটি পৃথক কমিটি গঠন করে পুলিশ।

# ১৪ জুন জেএমবি সদস্য বুলবুল আহমেদ ওরফে ফুয়াদকে বাকলিয়া থানার একটি হত্যা মামলায় রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। ফুয়াদকে এসপিপত্মী হত্যার বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা সে সময় জানান।

এরপর থেকে পুলিশের অভিযান চলমান থাকলেও নতুন কাউকে গ্রেপ্তার বা অগ্রগতির বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে মুখ খুলছিলেন না। অবশ্য ‘কয়েকদিনের মধ্যে’ রহস্য উন্মোচিত হবে বলে তারা আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিলেন।

এই সময়ের মধ্যে পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা চার-পাঁচজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সাংবাদিকদের কাছে তাদের কারও পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।