জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বাবুল আক্তারকে: মন্ত্রী

জঙ্গি দমন অভিযানের জন্য আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে গভীর রাতে ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 June 2016, 02:59 AM
Updated : 25 June 2016, 07:43 AM

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল শনিবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েকজন আসামির সামনে মুখোমুখি করে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।”

এসপি বাবুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না, বা তাকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এ প্রশ্নে মন্ত্রীর উত্তর, “এখনও বলার সময় হয়নি। শিগগিরই জানতে পারবেন।”

এদিকে বাবুল আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তার স্বজনদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সন্দেহ আর উদ্বেগ।

তার বাবা ও শ্বশুর বলছেন, বাবুলের স্ত্রী খুন হওয়ার পর থেকে পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে এসেছে; কিন্তু এখন তারাও সহযোগিতা ‘করছে না’।

বাবুল আক্তারকে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে রাখা হয়েছে বলে শোনা গেলেও এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না পুলিশের কোনো কর্মকর্তা।  

বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলছেন, শুক্রবার রাত ১টার দিকে তাদের বনশ্রীর বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে নিয়ে যায় খিলগাঁও থানার ওসি মঈনুল হোসেন ও মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার আনোয়ার হোসেন।

“আইজি সাহেব দেখা করতে বলেছেন বলে ওকে নিয়ে গেল। এরপর তার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারছি না। যারা নিয়ে গেল তাদের সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।”

ঢাকায় পুলিশ সদরদপ্তরে সংযুক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোডের বাসার অদূরে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় খুন হন।

মোটর সাইকেলে করে আসা তিন হামলাকারী মিতুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

চট্টগ্রামের পুলিশ বলে আসছিল, গত দুই বছরে চট্টগ্রামে জঙ্গি দমন অভিযানে বাবুলের ভূমিকার কারণে জঙ্গিদেরই সন্দেহের তালিকায় প্রথমে রেখেছেন তারা; সেভাবেই মিতু হত্যার তদন্ত করছেন তারা।  

মিতু হত্যার ঘটনায় চট্টগ্রামে যে মামলা হয়েছে, বাবুল আক্তারই তার বাদী। সে কারণে প্রায়ই তাকে পুলিশের কার্যালয়ে যেতে হত বলে মোশাররফ হোসেন জানান।  

তিনি বলেন, “আগেও ও রাতে গেছে। কিন্তু যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে এমন হয়নি। এ কারণে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না কেন? ফোন বাজছে, ধরছে না কেন? বাসায় দুই বাচ্চা কাঁদছে, মা তো আর নেই।”

এ বিষয়ে কথা বলতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে খিলগাঁওয়ের ওসি এবং মতিঝিলের উপ কমিশনারকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তারা ধরেননি। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকেও পাওয়া যায়নি।

স্ত্রী খুন হওয়ার পর থেকে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় শ্বশুর বাড়িতেই থাকছিলেন এসপি বাবুল আক্তার। তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন অবসরে গিয়েছিলেন পুলিশের ওসি হিসেবে।  আর বাবা আবদুল ওয়াদুদ মিয়াও চাকরি করেছেন পুলিশে।

শুক্রবার রাতে বনশ্রী থেকে যখন বাবুল আক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয়, তার বাবাও তখন ওই বাসায় ছিলেন।

স্ত্রী খুন হওয়ার পর স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার (সামনে মাঝে)।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাবে একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে যাওয়ার পর বাবুল জানায়, আইজি সাহেবের সাথে দেখা করবে। দেখা করার পর অনুষ্ঠান হয়েই বাসায় আসে ওরা। ওসি সাহেবও (মঈনুল হোসেন) তখন সঙ্গে ছিলেন।

“রাত পৌনে ১টার দিকে সবাই বাসায় ফিরল। কিছুক্ষণ পর ডিসি সাহেব (আনোয়ার হোসেন) আসেন এবং আইজি সাহেব দেখা করতে বলেছেন জানিয়ে বাবুলকে নিয়ে যান।”

ওয়াদুদ মিয়া বলেন, “আমার ছেলের সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। আগে ওসি সাহেব একবারেই ফোন ধরতেন, আমাদের নিরাপত্তার খোঁজ খবর নিতেন। এখন ফোনই ধরছেন না। ডিবি অফিসেও যোগাযোগ করেছি, কেউ কোনো সহযোগিতা করছে না; বলছে, উপরের অফিসাররা বলতে পারবে।”  

পরে মাদকের অপব্যবহার ও পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে ঢাকা ক্লাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “(মিতু হত্যার) ঘটনাটি দুঃখজনক। আমরা কনফিডেন্ট যে তাদের (দোষী) ধরতে সক্ষম হয়েছি।”

বাবুল আক্তারকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বাবুল আক্তার একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ওই এলাকার অনেককেই তিনি চেনেন, যাদের আটক করেছি তাদের কনফার্ম করার জন্য বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি।”

ঘটনাক্রম:

# মিতু হত্যাকাণ্ডের পরদিন ৬ জুন খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটি চট্টগ্রামের বাদুরতলা এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ।

# ওইদিনই বাবুল আক্তার নিজে বাদী হয়ে স্ত্রী খুনের ঘটনায় মামলা করেন। সন্দেহভাজন হিসেবে চারজনকে আটকের কথা জানায় পুলিশ। যদিও তাদের রাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়।

# ৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে আবু নসুর গুন্নু (৪৬) নামের একজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায়, তিনি একজন ‘সাবেক শিবির কর্মী’। মিতু খুনের পর ঘটনাস্থল অতিক্রম করা কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস ও তার চালককে একইদিনে আটক করে পুলিশ।

# ৯ জুন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে হাটহাজারী মুসাবিয়া দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতার উত্তরসূরীদের একপক্ষ দাবি করে ‘মাজার কেন্দ্রিক বিরোধের’ শিকার নসুর।

# ১০ জুন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে এসপিপত্মী খুনের ঘটনায় মানববন্ধন চলাকালে সন্দেহজনক ঘোরাফেরার অভিযোগে ইব্রাহিম (২৬) নামের রিকশাচালক এক যুবককে ছোরাসহ আটক করে পুলিশ।

# ১১ জুন নগরীর বায়েজিদ থানার শীতল ঝর্ণা এলাকা থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন (২৮) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় রাস্তার পাশের একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে যে যুবককে অনুসরণ করতে দেখা গিয়েছিল, ওই যুবকই রবিন বলে পুলিশের সন্দেহ।

# ১২ জুন গ্রেপ্তার নসুর ও রবিনকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি পায় পুলিশ। ওইদিন ঘটনা তদন্তে পাঁচটি পৃথক কমিটি গঠন করে পুলিশ।

# ১৪ জুন জেএমবি সদস্য বুলবুল আহমেদ ওরফে ফুয়াদকে বাকলিয়া থানার একটি হত্যা মামলায় রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে পুলিশ। ফুয়াদকে এসপিপত্মী হত্যার বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা সে সময় জানান।

এরপর থেকে পুলিশের অভিযান চলমান থাকলেও নতুন কাউকে গ্রেপ্তার বা অগ্রগতির বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে মুখ খুলছিলেন না। অবশ্য ‘কয়েকদিনের মধ্যে’ রহস্য উন্মোচিত হবে বলে তারা আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছিলেন।

এই সময়ের মধ্যে পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা চার-পাঁচজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সাংবাদিকদের কাছে তাদের কারও পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।