‘মৌলবাদ, সন্ত্রাসে মাথা নোয়াবে না প্রকাশকরা’

সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক মুক্তচিন্তার লেখকসহ প্রকাশক ও ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটলেও মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের কাছে ‘মাথা না নোয়ানোর’ ‍কথা বলছেন প্রকাশকরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2016, 04:44 PM
Updated : 24 June 2016, 05:10 PM

শুক্রবার ঢাকায় ‘মুক্তবিশ্বে প্রকাশনা’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিয়ে এই অঙ্গীকারের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি প্রকাশকরা অভিযোগ করেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে তাদের টুঁটি চেপে ধরছে নীতিনির্ধারকরা।

বিকালে ঢাকার হোটেল সোনারগাঁওয়ে দুইদিনব্যাপী এই সেমিনারের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম।

উদ্বোধনীতে সেমিনারের আয়োজক বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ওসমান গণি বলেন, “দেশে একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। সম্প্রতি জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়েছে।

এইচ টি ইমাম

“কিন্তু প্রকাশকরা এতে মোটেই ভর্কে যাননি। আমরা এসব মৌলবাদী উগ্র-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করব না।”

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শুদ্ধস্বর প্রকাশনার অফিসে প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুলের উপর হামলার একই সময় শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে খুন করা হয় প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে।

এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয় লেখক অভিজিৎ রায়কে, যার বই প্রকাশের কারণেই প্রকাশক দীপন ও টুটুলের ওপর হত্যার হুমকি ছিল মনে করা হয়।

গত দেড় বছরে অভিজিৎ ও দীপনের মতো একই কায়দায় ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, পুরোহিত, বৌদ্ধভিক্ষু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় অর্ধশত মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দুটি জঙ্গিগোষ্ঠীর নামে এসব হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের বার্তা এলেও জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মতো হোম-গ্রোন জঙ্গিরা এর পেছনে রয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সেমিনারে বাংলাদেশের মানুষদের ‘বইপ্রেমী’ হিসেবে অভিহিত করে কবি-সাহিত্যিকদের জন্য নির্বিঘ্নে লেখালেখি পরিবেশ তৈরির জন্য প্রকাশনা শিল্প সম্পৃক্তদের আহ্বান জানান ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের (আইপিএ) সভাপতি রিচার্ড চার্কিন।

“অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আমি দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ কতটা বইপ্রেমী। আমরা বিশ্বাস করি, সেরা বই দিয়ে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী, লেখক, সাহিত্যিকরা মানুষের চিন্তার খোরাক জোগাবে। অন্যদিকে প্রকাশনা শিল্পের দায়িত্ব হবে কবি-সাহিত্যিকদের জন্য সেরকম পরিবেশ তৈরি করা, যাতে তারা নির্বিঘ্নে লিখতে পারেন।”

ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে প্রকাশনা নিয়ে কাজ করে থাকে।

তাদের কাজের মধ্যে প্রকাশনা, পৃষ্ঠাপোষকতা, কপি রাইট, চিন্তার প্রকাশ, ভাবের আদান-প্রদানের পাশাপাশি সৃজনশীলতা বিষয়টিও গুরুত্ব পায় বলে জানান আইপিএ’র পরিচালক বেন স্টুয়ার্ড।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের প্রকাশনার বিষয়ে কথা বলতে গেলে এখানে মুক্ত চিন্তার লেখকদের চিন্তার উপর আঘাত, তাদের হত্যার বিষয়ে অবশ্যই কথা বলতে হয়। মৌলবাদীদের হাতে এরই মধ্যে মুক্তচিন্তার কয়েকজন লেখক হত্যার কথা আমরা জানি।”

উদ্বোধনীর বক্তৃতা পর্বের মাঝে মৌলবাদীদের হামলায় আহত প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের একটি খুদে বার্তা পড়ে শোনানো হয়।

এতে বলা হয়, “আজকের সেমিনারে না থেকেও উপস্থিত রয়েছেন জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিন দীপন। যে মুক্তচিন্তার বই প্রকাশ করে মৌলবাদীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। সে সঙ্গে আরেকজন প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিক, বই প্রকাশের জন্য কারাগারে বন্দি রয়েছেন।”

অনুষ্ঠানের সভাপতি এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “প্রকাশনা শুরুর পরই সেন্সরশিপ ব্যবস্থার সঙ্গে প্রকাশকদের স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব চলে আসছে।”

তিনি বলেন, “কয়েক বছরে ব্লগার, প্রকাশক ও লেখকদের হত্যা করা হয়েছে। উগ্রপন্থিরা ঠিক করেছে হত্যাই একমাত্র সমাধান। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এসব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে।”  

তবে শত সমস্যার পরেও বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে চলছে বলে মনে করেন সেমিনারের উদ্বোধক এইচ টি ইমাম।

“শত সমস্যার পরেও আমাদের দেশে প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে চলছে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও পাঠকসংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি সেখানেও প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠছে।”

বিভিন্ন প্রকাশনায় ধর্মভিত্তিক আলোচনায় সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি বিষয়ক এই উপদেষ্টা।

“স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা না।কোনো কিছুর বৈধতা দেওয়া মানে কোনো কিছুর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা দেওয়া না। আপনি এমন কিছু বলতে পারেন না যা অন্যের স্বাধীনতায় আঘাত করে। আপনার কোনো অধিকার নেই অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে গালাগাল করার।”

বাংলাদেশে ১২টি ‘বিপন্ন’ ভাষা পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়ে এইচ টি ইমাম বলেন, “বাংলাদেশের প্রকাশকদের শুধু বাংলা ভাষাকে ধারণ করলেই হবে না, বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্য ভাষাকেও ধারণ করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”

সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ বলেন, “প্রকাশনায় নানা সমস্যা রয়েছে, কিন্তু সরকার এসব ব্যাপারে সচেতন রয়েছে। বেআইনি কার্যক্রমের দায়ে অভিযুক্ত হলে প্রকাশনাকে কোনোভাবেই অনুমোদন দেব না আমরা।”

ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের (আইপিএ) সভাপতি রিচার্ড চার্কিন

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, “আমাদের দেশে সব লেখকই সব কিছু নিয়ে লিখতে পারে, লেখকদের চিন্তার স্বাধীনতা রয়েছে। তবে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এবং ধর্মীয় বিষয়ে কোনো বাজে মন্তব্য বা লেখা হলে সেটা বরদাস্ত করা হয় নি এবং হবে না। ধর্মীয় উসকানিকে আমরা স্বাগত জানাই না”

উদ্বোধনী পর্ব শেষে সেমিনারের প্রথম সেশন অনুষ্ঠিত হয়।

‘প্রকাশনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা’ শিরোনামে এ সেশনের সভাপতিত্ব করেন প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।

আলোচনায় অংশ নেন রিচার্ড চার্কিন, বেন স্টুয়ার্ড, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন।

এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী পরিচালক কামরুল হাসান শায়ক।

শনিবার সেমিনারের শেষ দিন। এদিন তিনটি সেশন অনুষ্ঠিত হবে। সেশনগুলো হলো ‘দেশীয় প্রকাশনার আন্তর্জাতিককরণ’, ‘প্রকাশনায় নারী’ ও ‘প্রকাশনার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা’।

শনিবার বেলা ১১টায় ‘দেশীয় প্রকাশনার আন্তর্জাতিককরণ’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করবেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর ও আর্টস সম্পাদক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

সমাপনী আয়োজনে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।