ধর্মের বর্মে জঙ্গিবাদ ঠেকানো যাবে না: মেনন

কোনো ব্লগারকে হত্যার পর ‘ধর্মের বিরুদ্ধে আঘাত সহ্য করা হবে না’ ঘোষণা দিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ‘ধর্মবিরোধী লেখা’ খুঁজে বেড়ানোর সমালোচনা করে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ধর্মের বর্ম পরে জঙ্গিবাদ ঠেকানো যাবে না।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 June 2016, 09:39 AM
Updated : 21 June 2016, 12:06 PM

জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় সম্প্রতি কথিত বন্দুকযদ্ধে ‘জঙ্গি’ নিহত হওয়ার ঘটনাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘দুর্বলতা’ বলেও আখ্যা দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি।

মেনন বলেন, “আমরা দেখি যখনই কোনো ব্লগার নিহত হন, তখনই পুলিশ কর্তৃপক্ষ তিনি ধর্মবিরোধী কিছু লিখেছেন কী না সেটা খুঁজে বেড়ান। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে উচ্চারণ করা হয় ধর্মকে আঘাত করে এমন কিছু সহ্য করা হবে না। এটা ঠিক যে ধর্মবিরোধী কোনো কিছু লেখা উচিত নয়। তেমনি আবার কেউ নিহত হওয়ার পর একথা উচ্চারিত হলে ওই হত্যা জাস্টিফায়েড হয়ে যায়।

“ধর্মকে বর্ম করে ধর্মের ধ্বজাধারী খুনি জঙ্গিদের বিরত করা যাবে না। বরং তাদের কাছে আত্মসমর্পণই করা হবে।”

গতবছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার পর একই কায়দায় খুন হন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয়, অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ।

এর আগে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর কয়েক দিনের মাথায় খুন হয়েছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার।

এদের মধ্যে অনন্ত যে ব্লগে লেখালেখি করতেন, ‘মুক্তমনা’ নামে ওই ব্লগসাইট চালাতেন অভিজিৎ।

প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার একসঙ্গে উপস্থিত থাকার এই ছবি গত জুন মাসের। এমন দৃশ্য কমই দেখা গেছে নবম সংসদের মেয়াদকালে।

অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিজিৎকে ‘ঘোষিত নাস্তিক’ উল্লেখ করে বলেন, “আমরা (আওয়ামী লীগ) নাস্তিক হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। তবে এতে আমাদের মূল আদর্শের কোনো বিচ্যুতি হবে না। আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী।”

ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, “বিরোধী দল আমাদের বিরুদ্ধে লাগাতার ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করায় আমরা তার (অভিজিৎ) পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছি না।”

হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে সরকারের কার্যক্রমের নিয়ে ওঠা সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় জয় বলেছিলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য এতটাই নাজুক যে প্রকাশ্যে তার কিছু বলা স্পর্শকাতর ছিল, তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে অভিজিতের বাবাকে সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন।

নিহত সব ব্লগারের লেখা পড়েছেন জানিয়ে সংসদে মেনন বলেন, “সেখানে মুক্তমনের প্রতিফলন আছে, কিন্তু ধর্মবিরোধী কোনো কিছু আমার চোখে পড়েনি।”

কথিত বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনার সমালোচনা করে সরকারে জোটসঙ্গী দলের এই নেতা বলেন, “আজকে প্রতিদিনই দেখছি ক্রসফায়ারে জঙ্গি নিহত হচ্ছে। ক্রসফায়ার এই সমস্যার সমাধান নয়। বরঞ্চ তার মধ্য দিয়ে আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা-ব্যর্থতা দেখছি।” 

তিনি বলেন, “আমাদের দেশে আইএস নেই তবে তাদের অনুগামী রয়েছে, এরাই গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। তাদেরই গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন পুরোহিত, যাজক, বৌদ্ধভিক্ষু, মাজারের খাদেম, পীর, বাউল গবেষক, শিক্ষক, সমাজের সংখ্যালগিষ্ঠ অংশের মানুষ। এই আক্রমণ কোনো একক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, সমগ্র বাংলাদেশের ওপর।

“এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরি করা হচ্ছে এবং তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে।”

আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরেও সাস্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেরন তিনি।

মেনন বলেন, “যে অসাম্প্রদায়িকতা-ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম, সেই সেক্যুলার ডেমোক্রেসিই বাংলাদেশকে আধুনিক ও উন্নত বালাদেশে রূপ দিতে পারে।”

সেজন্য মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষক মৌলবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার উপর জোর দেন তিনি।

“গত নবম সংসদে আমি এই মৌলবাদী অর্থনীতির ধারকদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বেসরকারি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব এনেছিলাম। সেটা নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু কোন মন্ত্রণালয় সেটা বাস্তবায়ন করবে সেই অজুহাতে তা হিমাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ যে কত বাস্তব সেটা আমরা সবাই অনুধাবন করছি।”

২০১৪ সালে দেশের মূল অর্থনীতির মধ্যে মৌলবাদী অর্থনীতির ২ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা নীট মুনাফা হয়েছে বলে সংসদে তথ্য দেন মেনন।

মেনন বলেন, “দেশি-বিদেশি অর্থ নিয়ে জঙ্গি গ্রুপ গঠন হয়েছে। এরাই গুপ্ত হত্যায় মেতে উঠেছে। এরই অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইইউসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশে আগমনেচ্ছুদের জন্য ট্রাভেল অ্যাডভাইজরি দিচ্ছে যেন বাংলাদেশে না আসেন। বিনিয়োগ না করার আহ্বান জানাচ্ছে।”

সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যার কথা তুলে ধরে সংসদে জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, “আমরা অনেক দূর এগিয়েছি- সেটা সত্য। আমার ক্রমাগত ভাবনা এই যে, চাপাতির সন্ত্রাস শুরু হয়েছে এরা কারা? গুপ্তহত্যাকারীরা কারা? চৌদ্দপুরুষের সম্পর্ক নেই তাদেরকে হত্যা করছে। এরা রোবট। আমার কাছে মনে হয়, শিক্ষায় আমরা অনেক ভালো করেছি। কিছু চাকরিজীবী তৈরি হয়েছে, সংষ্কৃতিকর্মী তৈরী হয়নি।

“প্রতি তিন জনে একজন মাদ্রাসার ছাত্র। কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা বিশাল। কওমি মাদ্রাসার সংস্কৃতি কি? সে মুক্তিযুদ্ধের কি শিক্ষা গ্রহণ করে? মুক্তিযুদ্ধের মৃত্তিকাকে অগ্রহ্য করে বাংলাদেশে মানুষ হওয়া যাবে না।”

ইসিতে শুনানি শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি মইন উদ্দীন খান বাদল

‘অর্থনৈতিক সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের প্রতি টলারেন্স কেন?’

দেশের অর্থনৈতিক খাতের ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের প্রতি সরকার সহনশীলতা দেখাচ্ছে কী না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় মঙ্গলবার সংসদে জাসদ একাংশের এই কার্যকরী সদস্য বলেন, “প্রতিদিন আমরা বলছি জিরো টলারেন্স। যারা সন্ত্রাস করে তাদের প্রতি জিরো টলারেন্স এবং হর হামেশাই দেখছি ক্রসফায়ার। কিন্তু আমি প্রশ্ন করতে চাই, যারা বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড খুবলে খায়, যে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসীরা-জঙ্গিরা তাদের প্রতি কেন টলারেন্স দেখাচ্ছেন?

“একের পর এক ব্যাংক কেলেঙ্কারি হয়েছে, আমরা বিচার করতে পারি না। হলমার্ক, বিছমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংক, ওম প্রকাশ আগারওয়াল টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে, নুরুন্নবী...। আমরা লক্ষ্য করছি রিজার্ভ চুরি বাংলাদেশ ব্যাংকে, মামলা হয়েছে এগোতে পারছি না। শেয়ার বাজার; কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা নেই। হলমার্ক সাজা হয়নি। বেসিক ব্যাংক মামলায় নেই আব্দুল হাই বাচ্চু, ডেসটিনির সাজা হয়নি।”

বাদল আরও বলেন, “আর্থিক সন্ত্রাসীদের, আর্থিক জঙ্গিদের ব্যাপরে সরকার নির্মোহ হয়ে দৃঢ় আচরণ করতে না পারলে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিলে বিত্তের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করলে ইতিহাস আমাদের একদিন সংবিধান লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করবে।”