পঞ্চম দফার ভোটে দুই প্রার্থীসহ নিহত ১১

ইউপি নির্বাচনের পঞ্চম ধাপেও সহিংসতা ছিল আগেই মতোই; ভোটগ্রহণের সময় সংঘাতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১১ জন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 May 2016, 01:18 PM
Updated : 28 May 2016, 01:18 PM

শনিবার সারাদেশে ৪৫টি জেলার ৭১৭টি ইউনিয়নে একযোগে ভোটগ্রহণ চলে। এর মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।

সংঘর্ষে দুজন প্রার্থী নিহত হয়েছেন। তাদের একজন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী। অন্যজন চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর বড় উঠান ইউনিয়নে সদস্য প্রার্থী।

কর্ণফুলীর একই ঘটনায় আহত আরেকজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যায় মারা যান।

এদিন সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদে। সেখানে সংঘর্ষ থামাতে পুলিশকে গুলি ছুড়তে হয়। সংঘর্ষে মারা যান অন্তত চার জন।

ভোটের মধ্যে নোয়াখালীতে যুবলীগের এক কর্মীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ভোটের গোলযোগের মধ্যে নোয়াখালীতে একজন এবং চট্টগ্রামের পটিয়ায় একজনের মৃত্যু ঘটে।

ভোটের ফল ঘোষণার পর রাতে পঞ্চগড় সদর উপজেলার গড়িনাবাড়ি ইউনিয়নে পরাজিত ইউপি সদস্যের সমর্থকদের হামলায় বিজয়ী প্রার্থীর এক সমর্থক নিহত হয়েছেন। 

এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মুন্সীগঞ্জের কয়েকটি ইউনিয়নে ব্যাপক গোলযোগ হয়েছে। তাতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত সাড়ে তিন মাসে সহিংসতায় ৮০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সংঘর্ষ-হামলার ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিনই।

দলীয় প্রতীকে প্রথম ইউপি নির্বাচনে এবার বেশিরভাগ সংঘাতই হয়েছে দল মনোনীত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে।

দলীয় প্রার্থী ও বিদ্রোহীদের কারণে গোলযোগের প্রবণতাও বেড়েছে স্বীকার করে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেছেন, “মানসিকতার পরিবর্তন না হলে গোলযোগ ও অভিযোগের শেষ হবে না।”

জামালপুর: দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের ফুটার চর এবতেদায়ি মাদ্রাসা কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের চারজন নিহত এবং অন্তত ২০ জন আহত হন।

বাহাদুরাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী সাকিরুজ্জামান রাখাল ও আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী মো. শাহজাহানের সমর্থক এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলেন- কুতুবের চর গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে জিয়াউর রহমান, শেখপাড়ার আফজাল হোসেনের ছেলে আব্দুল মাজেদ, আমজাদ হোসেনের ছেলে নবীরুল ইসলাম ও নুরে আলম।

জাহাঙ্গীর বলেন, “সংঘর্ষের সময় তিন পক্ষই গুলি ছোড়ে। আর চারজনই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।”

জামালপুরে সংঘর্ষের চিত্র

জামালপুরের পুলিশ সুপার মো. নিজাম উদ্দীন বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ শটগানের গুলি ছুড়েছে।”

সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করে এই মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলমগীরকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যর তদন্ত কমিটিকে আগামী ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

কুমিল্লা: তিতাস উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নে নাগেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী কামাল উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তোফায়েল আহমেদ ও তার সমর্থকরা প্রতিদ্বন্দ্বী কামালের উপর হামলা চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শী নিহতের চাচাত ভাই বশির আহমেদ দাবি করেছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোট চলাকালে কামাল উদ্দিন কেন্দ্রে গেলে তোফায়েল ও তার লোকজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।”

আহত কামালকে তিতাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রাম: কর্ণফুলী থানা এলাকার বড় উঠান ইউনিয়নের শাহ মিরপুর এলাকায় সংঘর্ষে নিহত হন সদস্য প্রার্থী মো. ইয়াছিন (৪০)। তিনি ওই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদে প্রার্থী ছিলেন।

একই ঘটনায় মোহাম্মদ হোসেন (৫০) নামে ছুরিকাঘাতে আহত আরও একজন সন্ধ্যা ৭টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বলে জানান হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই পংকজ বড়ুয়া।বেলা সোয়া ১টার দিকে শাহ মিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাঁধে বলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) হারুনুর রশিদ হাজারী জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোট কেন্দ্র থেকে দূরে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে ইয়াছিন নিহত হন।”

চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই জহিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইয়াছিনের পেটে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন আছে।

কেন্দ্রে মোতায়েন থাকলেও সংঘর্ষস্থল কিছুটা দূরে হওয়ায় সেখানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য ছিলেন না।

পুলিশ কর্মকর্তা হাজারী বলেন, কেন্দ্রের বাইরে এ ঘটনা ঘটার পরও সেখানে ভোট গ্রহণ চলে।

পটিয়া উপজেলায় আশিয়া ইউনিয়নের এক কেন্দ্রে সংঘর্ষের সময় ‘হৃদরোগে’ বাবুল শীল (৬৫) নামে এক ভোটারের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আসাদ আলী ফকির মাজার সংলগ্ন মাদ্রাসা কেন্দ্রে দুই সদস্য প্রার্থীর সংঘর্ষের সময় মারা যান বাবুল। মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা বাবুল সেলুনে কাজ করতেন।

চট্টগ্রামে নির্বাচনী সংঘাতে আহত একজন

পটিয়া থানার ওসি রেফায়েত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোট দিতে আসা ওই ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।”

হৃদরোগে তার মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে জানান ওসি।

তবে বাবুল শীলের ছেলে জিতেন শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সদস্য প্রার্থী শফিকুল ইসলাম ও নুরুল করিমের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় আমার বাবাকে মারধর করে মেরে ফেলা হয়।”

এজন্য শফিকুল ইসলামের পক্ষের লোকজনদের দায়ী করেন জিতেন।

নোয়াখালী: বেগমগঞ্জ উপজেলায় গুলিতে এক কিশোর এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তাড়া খেয়ে পালানোর সময় এক বৃদ্ধ মারা গেছেন।

উপজেলার জিরতলী ইউনিয়নে বাংলাবাজার কেবি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মো. শাকিল (১৬)।

শাকিল জিরতলী ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের মো. মিলনের ছেলে।

তার দাদা মো. হারুন বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কেন্দ্রের বাইরে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘গুলি ছুড়লে’ শাকিল গুলিবিদ্ধ হয়।

শাকিলকে ঢাকায় নেওয়ার পথে তার মৃত্যু ঘটে।

এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াছ শরীফ বলেন, “দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষের গুলিতে শাকিলের মৃত্যু হয়েছে।

“পুলিশ সেখানে কোনো গুলি ছোড়েনি, তাই পুলিশের গুলিতে শাকিলের মারা যাওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন।”

এদিকে রাজগঞ্জ ইউনিয়নের দারুল উমল ফাজিল সিনিয়র মাদ্রাসা কেন্দ্রের সামনে র‌্যাবের ধাওয়া খেয়ে সবার সঙ্গে পালানোর সময় দেয়ালে মাথায় আঘাত পান সৈয়দ আহম্মদ নামে (৬০) এক ব্যক্তি।

তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান বেগমগঞ্জ থানার ওসি সাজিদুর রহমান সাজেদ।

পঞ্চগড়: নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় এ জেলায় নিহত হয়েছেন একজন। আহত হয়েছেন নারীসহ আরও ১৩ জন। নিহতের নাম নাসির উদ্দীন (৫৫)।

নাসির সদর উপজেলার গড়িনাবাড়ি ইউনিয়নের কড়েয়া পাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসাবে কাজ করতেন।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তিনি ওই ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের বিজয়ী ইউপি সদস্য তরিকুল ইসলামের সমর্থক ছিলেন।

নাসির উদ্দীনের প্রতিবেশি মো. রবিউল ইসলাম জানান, ৩নং ওয়ার্ডে জোতদার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে রাত ৯টার দিকে ফল ঘোষণার পর পরাজিত ইউপি সদস্য প্রার্থী ফুটবল প্রতীকের আনোয়ার হোসেনের কর্মী-সমর্থকরা বিজয়ী প্রার্থী তরিকুল ইসলামের সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়।

“এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বল্প সংখ্যক সদস্যসহ লোকজন ছুটোছুটি করে আত্মরক্ষা করে। কিছুক্ষণ পর আমি ও অন্যরা নাসির উদ্দীনকে বিদ্যালয় মাঠে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে প্রথমে তার বাড়িতে ও পরে পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই।”

হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি জানান, হামলায় নাসিরের স্ত্রী নুরজাহান (৪৮), ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত চার পুলিশ ও আনসার সদস্যসহ মোট ১৩ জন আহত হয়েছেন।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক এসএম রাজিউল করিম রাজু জানান, হাসপাতালে মৃত অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হয়েছিল।

রবিউল ইসলাম জানান, নাসিরের গলার বাম পাশে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। অবশ্য মৃতদেহের কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন এসআই রঞ্জু আহমেদ।

“এজন্য চিকিৎসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছে চট্টগ্রাম ব্যুরো এবং জামালপুর, কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলা প্রতিনিধি]