শ্যামলের পদত্যাগপত্র নেওয়া হয় ‘জোর করে’, ছাত্রের বক্তব্য ‘অসংলগ্ন’

নারায়ণগঞ্জের লাঞ্ছিত স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের কাছ থেকে ‘জোর করে’ সই নিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ পদত্যাগপত্র আদায় করেছিল বলে আদালতকে জানাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2016, 06:05 AM
Updated : 26 May 2016, 02:27 PM

যে ছাত্রের বক্তব্যের ভিত্তিতে বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেই শিক্ষার্থীও ‘একেক সময় একেক কথা বলেছে’ বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক শ্যামলের বিরোধের মধ্যে তার বিরুদ্ধে কোনো একটি পক্ষ ধর্ম অবমাননার ধুয়া তুলে স্থানীয়দের প্ররোচিত করেছিল বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

যে প্রক্রিয়ায় শ্যামল কান্তিকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তা বিধিবহির্ভূত হওয়ায় তাকে ওই পদে বহাল রাখার সুপারিশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত এই তদন্ত কমিটি।

আলোচিত এই ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিটি আদালতে উপস্থাপন করতে বৃহস্পতিবার তাদের প্রতিবেদন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে জমা দেয়।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চার দফা সুপারিশ ও মতামতসহ কমিটির ওই প্রতিবেদন হাতে এসেছে। হলফনামা করা হয়েছে, রোববার প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হবে।”

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত ১৩ মে স্কুলপ্রাঙ্গণে শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে মারধর করে স্থানীয় একদল লোক। পরে তাকে কান ধরিয়ে উঠ-বস করান স্থানীয় সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান।

দেশজুড়ে প্রতিবাদ ও দোষীদের বিচার দাবির মধ্যেই ওই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে পুনর্বহাল করে, ভেঙে দেয় পরিচালনা পর্ষদ।

ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় উঠলে তা নজরে আসার পর হাই কোর্ট সাংসদ সেলিম ওসমানসহ যাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ১৮ মে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দিয়েছিল।

পাশাপাশি ওই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাও জানতে চেয়েছিল।

স্থানীয়দের সাক্ষ্য নিচ্ছে তদন্ত কমিটি

আদেশ পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেয় আদালত। সেইসঙ্গে ২৯ মে প্রয়োজনীয় আদেশের জন্য বিষয়টি আবার উঠবে বলে জানায় আদালত।

ওই আদেশের সূত্র ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয় বলে জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ এবং নারায়ণগঞ্জের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুছ ছামাদ স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে চার দফা মতামত ও সুপারিশ রয়েছে।

চার সুপারিশ

ক) যেহেতু স্কুলের অর্থ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের দ্বন্দ্ব ও অনাস্থা বিরাজমান, সেহেতু উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আর্থিক বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানসম্পন্ন কোনো বিশেষ কমিটি দ্বারা অধিকতর তদন্ত করা যেতে পারে।

খ) বর্তমান স্কুল ম্যানেজিং কমিটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ইতিমধ্যে এটি হয়েছে।

গ) যেহেতু অভিযোগকারী (দশম শ্রেণির এক ছাত্র) স্কুল কমিটির সামনে উপস্থাপিত জবানবন্দি ও গণমাধ্যমে প্রদত্ত জবানবন্দি এবং তার মায়ের লিখিত অভিযোগ ও মৌখিক অভিযোগের মধ্যে গরমিল লক্ষ করা যায় (বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত), সেহেতু বিতর্কিত বিষয়টির সত্যতা গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিবেচিত হতে পারে।

ঘ) প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগপত্র জোর করে আদায় ও সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি আইনসিদ্ধ হয়নি বিধায় তিনি স্বপদে বহাল আছেন বলে বিবেচিত হতে পারে।

.

এই কমিটির তদন্তের ভিত্তিতেই শ্যামল কান্তিকে স্বপদে পুনর্বহালের পাশাপাশি ওই স্কুলের পরিচালন পর্ষদ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

গত ১৯ মে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে লাঞ্ছিত করার আগে ধর্ম অবমাননার যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, প্রাথমিক তদন্তে তার সত্যতা মেলেনি।

এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান নিজের কাজের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগটিই তুলে ধরে আসছেন।

চার মতামত

প্রথম, প্রাথমিক তথ্য ও সাক্ষ্য যাচাই করে প্রতীয়মান হয় যে, স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলমান রয়েছে। যা কখনও মীমাংসা করার উদ্যোগ কোনো পক্ষ থেকেই গ্রহণ করা হয়নি।

দ্বিতীয়, উপস্থিত সাক্ষ্যগণ ও সহিংসতার শিকার স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, ১৩ মে (শুক্রবার) যে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে তার পেছনে নিকটস্থ মসজিদের মাইক ব্যবহারকারী অজ্ঞাত কোনো পক্ষ প্রধান শিক্ষকের নামে ধর্মীয় কটূক্তির বিষয়ে যে বিষোদগার মাইকে প্রচার করে জনগণকে উত্তেজিত করতে প্ররোচনা দিয়েছে, তা উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়।  

তৃতীয়, অভিযোগ উপস্থাপনকারী পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির যে অভিযোগ উপস্থাপন করছে, তাতে মতভেদ রয়েছে এবং অভিযোগকারীর মায়ের লিখিত অভিযোগনামায় আরও বেশি সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মোবারক হোসেন তদন্ত কমিটির কাছে ধর্মীয় কটূক্তির বিষয়ে বক্তব্য দিলেও তিনি কয়েকটি টিভির মাধ্যমে ধর্মীয় কটূক্তি সম্পর্কে কিছু প্রকাশ করেননি।

চতুর্থ, প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য মতে তার কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগপত্র আদায় করা কিংবা পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো বিধিবহির্ভূত।

নারায়ণগঞ্জে শিক্ষককে কান ধরিয়ে উঠ-বস ‘কলঙ্কজনক’ মন্তব্য করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ইতোপূর্বে বলেন, এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই দোষীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন তারা।