ভুল আইনে বিচার: ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের রায়

পনের বছর আগের ধর্ষণের এক ঘটনায় ‘ভুল আইনে’ বিচার করায় ভোলার চরফ্যাশনের আব্দুল জলিলকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2016, 08:14 AM
Updated : 25 May 2016, 05:12 PM

সেইসঙ্গে জলিলের দণ্ডাদেশ বাতিল করে অন্য কোনো মামলায় গ্রেপ্তার না থাকলে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে বলা হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জলিলের করা জেল আপিল নিষ্পত্তি করে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমানের একক বেঞ্চ এই রায় দেয়।

ওই রায় প্রকাশিত হওয়ার পর বুধবার আদালতের আদেশের বিস্তারিত জানা যায়।

বর্তমানে প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী জলিলকে ২০০১ সালের এক ধর্ষণের ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। সেই সঙ্গে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন বিচারক।

সে সময় তার বয়স ১৫ বছর। কিন্তু শিশু আইনে বিচার না করে তার বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে।

হাই কোর্টের রায়ে আদালত বলেছে, “এই আদালত মনে করে, রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক আসামি আব্দুল জলিলকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করাই যুক্তিযুক্ত। এ মর্মে এই আদালত আসামি আব্দুল জলিলের জীবনের ১৪টি বছরের বিনিময়ে রাষ্ট্রপক্ষকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করার আদেশ প্রদান করছে।”

পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে-

>> নাবালক হলেও জলিলের বিচার শিশু আইনে হয়নি; যার ফলে তিনি আইনের আশ্রয় পাননি।  

>> হাই কোর্ট প্রথম দফা মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য পাঠালেও বিচারিক আদালত নির্দেশনা অনুসরণ করেনি, রায় থেকেছে অপরিবর্তিত।

>> হাই কোর্ট আসামিকে নাবালক বললেও নিম্ন আদালতের বিচারক তাতে গুরুত্ব দেননি; ফলে শিশু জলিল অবিচারের শিকার হয়েছেন।

>> রাষ্ট্রপক্ষের সময়ের আবেদন মঞ্জুর হয়েছে বার বার, কিন্তু শিশু জলিলের জামিন হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী সমান অধিকার তাকে দেওয়া হয়নি।

>> জলিলকে নাবালক বিবেচনা করে ভোলার জেলা ও দায়রা জজ এ মামলার বিচারে জুভেনাইল কোর্ট গঠন করলেও তা এড়িয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেই তার বিচার করা হয়।

>> হাই কোর্ট বলেছে, নিম্ন আদালতের বিচারক উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অবহেলা করেছেন। এর দায় থেকে তিনি অব্যাহতি পেতে পারেন না।

>> উচ্চ আদালত বলেছে, রাষ্ট্র অবিচারের মাধ্যমে রায় হাসিল করলে তার দায় থেকে রাষ্ট্রপক্ষ অব্যাহতি পাওয়ার যোগ্য নয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, হাই কোর্ট জলিলের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগকে একটি ‘মিথ্যা মামলা’ বলে মনে করেছে।

তবে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের যে আদেশ আদালত দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আপিল করা উচিৎ বলে মনে করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, তার হাতে থাকা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জলিল এখনও মুক্তি পাননি।

‘আইনের আশ্রয় পাননি’ জলিল

রায়ে হাই কোর্ট বলেছে, তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী অভিযোগপত্র দাখিলের দিন আসামির বয়স ছিল ১৫ বছর। অথচ ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের ২ (জি) ধারায় ষোল বছরের কম বয়সীদের শিশু অভিহিত করা হয়েছে।

“এ কারণে জলিল শিশু আইন ১৯৭৪ এর বিধান অনুযায়ী প্রকৃত বয়স নির্ধারণ পূর্বক বিচারপ্রাপ্তির অধিকারী ছিল। কিন্তু ওই অধিকার হতে বঞ্চিত করে সাধারণ আইনে বিচার করায় সে (জলিল) সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের আওতায় আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।”

১৪ বছর ক্ষতির ‘সামান্য পূরণ’

রায়ে হাই কোর্ট প্রশ্ন রেখেছে, ২০০১ সালে ১৩ নভেম্বর থেকে ১৪ বছর ধরে আব্দুল জলিলকে জেল হাজতে আটক রেখে তার জীবনের যে ক্ষতি করা হয়েছে, তা পূরণ হবে কীভাবে?

“দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বিচার চলার সময় শিশু আসামি আব্দুল জলিল যখন জেল-হাজতে আটক, প্রসিকিউশন পক্ষ মামলার সাক্ষী আনতে ব্যর্থ হলে প্রতিটি ধার্য তারিখে সময় প্রার্থনা করা হলে তা অবলীলায় মঞ্জুর করে দেওয়া হত।”

রাষ্ট্রপক্ষের সময় মঞ্জুরের ৫২টি আদেশ এবং আসামি জলিলের জামিন নামঞ্জুর হওয়ার আদেশের হদিস পাওয়ার কথা জানিয়ে হাই কোর্ট রায়ে বলেছে, আসামি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত সে আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার পাওয়ার যোগ্য।

“এই মামলায় শিশু আব্দুল জলিলকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।... ফৌজদারি আইন ১৮৯৮ অনুযায়ী এই মামলার প্রসিকিউটর হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র যে কোনো প্রকারে বিচারিক আদালত কিংবা ট্রাইব্যুনাল থেকে অবিচারের মাধ্যমে রায় হাসিল করলে তার দায় থেকে রাষ্ট্রপক্ষ অব্যাহতি পাওয়ার যোগ্য নয়। অর্থনৈতিকভাবে আসামি জলিলকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে তার জীবনের দুঃখ কিছুটা হলেও ঘোচাতে রাষ্ট্রপক্ষ বাধ্য।”

‘গুরুত্ব পায়নি’ উচ্চ আদালতের আদেশ

প্রসিকিউশনের নথি থেকে জানা যায়, ২০০১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রতিবেশীর পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুকে ‘প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের’ অভিযোগে পরদিন চরফ্যাশন থানায় মামলা হয়।

ওই মামলায় ভোলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইবুনাল ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট আবদুল জলিলকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে জলিল হাই কোর্টে আপিল করেন। হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ ওই জেল আপিল মঞ্জুর করে জলিলের দণ্ডাদেশ বাতিল করে মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য বিচারিক আদালতে পাঠায়।

হাই কোর্টের সর্বশেষ রায়ে বলা হয়, আব্দুল জলিল অপরাধ সংঘটনের সময় নাবালক ছিলেন কি না তা নির্ণয় করার নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ। ভিকটিম ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ না হওয়ার বিষয়টি ধরিয়ে দিয়ে ওই বেঞ্চ বিচারিক আদালতকে বলেছিল, যাতে সাক্ষ্য নিয়ে হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মামলাটির নিষ্পত্তি করা হয়।

এরপর ২০১০ সালের ৮ মার্চ ভোলার অতিরিক্ত দায়রা জজ জলিলকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।

ওই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে আবারও আপিল করেন জলিল। তার নিষ্পত্তি করে গত ১৫ ডিসেম্বর রায় ঘোষণা করে হাই কোর্ট।

জুভেনাইল কোর্ট হলেও বিচার হয়নি

নথি পর্যালোচনায় হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, অপরাধ ঘটার তারিখে আসামি যে নাবালক ছিল- তা বিশ্বাস করেননি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক। অথচ অভিযোগকারী নিজেই এজহারে আসামির বয়স ১৬ লিখেছেন।  তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে আসামির বয়স লিখেছেন ১৫ বছর।

২০০১ সালের ২৮ নভেম্বর অভিযোগপত্রটি বিচারিক আদালতে দাখিল করা হলে ভোলার জেলা ও দায়রা জজ ২০০২ সালের ২১ জানুয়ারি জলিলকে দেখে নিশ্চিত হন যে, সে বয়সে শিশু। এ কারণে তিনি এ মামলার বিচারে জুভেনাইল কোর্ট গঠন করেন।

জজ আদালতের ওই আদেশে বলা হয়, আসামি আব্দুল জলিল ও ভিকটিম উভয়ই নাবালক হওয়ায় ১৯৭৪ সালের দ্য চিল্ড্রেন অ্যাক্ট অনুযায়ী এ মামলার বিচার পরিচালনার জন্য জুভেনাইল কোর্ট গঠন করা হল। 

এরপরও শিশু আইন অনুসরণ না করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এ মামলার বিচার হয় এবং আসামিকে যাবজ্জীবন সাজা দেয় আদালত। 

‘বিচারের বদলে অবিচার’

রায়ে হাই কোর্ট বলেছে, আইনের বিধান ছাড়া কোনো বিচার হলেও তা ‘অবিচার’ বিবেচিত হতে বাধ্য। প্রথম জেল আপিলে হাই কোর্ট জলিলকে ‘নাবালক’ বিবেচনা করার পরও ট্রাইব্যুনালের বিচারক যে কারণেই তাকে সাবালক বিবেচনা করে থাকুক না কেন, তা ‘বিচারের নামে খামখেয়ালিপূর্ণ অবিচারের সামিল’।

হাই কোর্ট মনে করছে, বিচারিক আদালত যথাযথভাবে নথি পর্যালোচনা না করায় উচ্চ আদালতের দেখিয়ে দেওয়া অসঙ্গতি ও অনিয়মগুলো দেখতে পাননি। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার ‘এই অবহেলার দায় থেকে’ সংশ্লিষ্ট বিচারক ‘অব্যাহতি পেতে পারেন না’।

“তিনি বিচারের বদলে অবিচার করেছেন। ফলে জলিলের দণ্ডাদেশ বহাল থাকতে পারে না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই এ আদালত সেই রায় ও দণ্ডাদেশ বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছে।”

ক্ষতিপূরণের অংক নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তি

হাই কোর্টের এ রায়ের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যে লোক নাবালক ছিল, তাকে সেইভাবে বিচার করা হয়নি। এতে তার অনেক কষ্ট পেতে হয়ে। আদালতের মতে এটি একটি মিথ্যা মামলা।”

আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আসামিকে এখন ৫০ লাখ টাকা দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের জন্য ‘খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে’ বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা। 

“এখানে রাষ্ট্রের কোনো ভুল নাই। কমপ্লেইন হয়েছে, বিচার হয়েছে, ভুল করলে বিচারক করে থাকতে পারেন বা প্রসিকিউটর করে থাকতে পারেন। সেজন্য আসামি অবশ্যই খালাস পাওয়ার যোগ্য এবং তাকে যদি মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে জরিমানা হওয়া উচিত তার, যে ওই মিথ্যা মামলা করেছে।”

এই রায়ে অর্থদণ্ড রাষ্ট্রের উপর ‘চাপানো হয়েছে’ মন্তব্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “এখানে আপিল করা উচিত। কিন্তু রায়ে অন্য যে পর্যবেক্ষণ আছে সেগুলোর বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রপক্ষের কোনো বক্তব্য নেই।”

ক্ষতিপূরণের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষকে আদালত অবশ্যই জরিমানা করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষকে জরিমানা করা হয় এজন্য যে রাষ্ট্রপক্ষ তদন্ত সংস্থা, আদালত সবই রাষ্ট্রের অধীনে। তবে ৫০ লাখ টাকা... এটা অতিরিক্ত হয়ে গেছে।”