বুয়েটের জন্য ‘নিজেকে ভুলে ছিলেন’ খালেদা একরাম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক খালেদা একরামের মৃত্যুর পর শিক্ষক ও উপাচার্য হিসাবে তার কর্মনিষ্ঠার বিষয়টি বড় হয়ে প্রকাশ পেয়েছে শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের কথায়।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2016, 11:15 AM
Updated : 24 May 2016, 03:46 PM

দূরারোগ্য নন হজকিনস লিমফোমাসহ নানা রকম শারীরিক জটিলতায় সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ৫ মিনিটে ব্যাংককের একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি।

তার অসুস্থতার সময় থেকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালনরত স্থাপত্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক জেবুন নাসরীন আহমদ প্রয়াতের সরাসরি শিক্ষার্থী ছিলেন।

পরবর্তীতে সহকর্মী হিসাবে পাওয়া খালেদা একরাম সম্পর্কে জেবুন নাসরীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মাসের ৮-৯ তারিখের দিকে তার নন হজকিনস লিমফোমা ধরা পড়লেও তিনি তাৎক্ষণিক হাসপাতালে যাননি। মিটিং করছেন, অফিস করছেন, কাজের মধ্যেই ছিলেন।”

“হঠাৎ করে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকল। তার মানে একেবারে লাস্ট স্টেজে এসে ধরা পড়েছে রোগটা। কিন্তু তিনি আমাদের বুঝতে দেননি, বুয়েটের কাজের জন্য নিজেকে ইগনোর করেছেন তিনি।”

অসুস্থতার মধ্যেও গত ১১ মে বিকালে নিজের বাসভবনে একটি পর্যালোচনা সভা ডেকেছিলেন উপাচার্য খালেদা একরাম। 

অধ্যাপক জেবুন বলেন, “ওই দিন সকালে আমরা উনাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়ার প্রক্রিয়া করছিলাম। উনার মুখ থেকে কথা সেভাবে বুঝা যাচ্ছিল না; ওই সময়ে তিনি বলছিলেন, ‘মিটিংটা করেই হাসপাতালে যাই’।

“অনেকটা জোর করে ১১ তারিখ দুপুরের দিকে হাসপাতালে ভর্তি করি উনাকে।”

তিনি বলেন, “উনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতেন প্রত্যেকটা ডিসিশন ডিটেইলসে যেতে চাইতেন। এমন কোনো মানুষ নেই যাকে তিনি খুশি করে রাখতেন না। যে যা-ই বলুক, তাকে শেষে একটা মানিয়ে দেওয়ার মতো বিরাট একটা গুণ উনার ছিল।

“আমরা তো উনার শিক্ষার্থী। শিক্ষকদের মধ্যে যাদের উনি পড়ানও তারাও উনাকে খুব ভালবাসতেন।”

১৯৫০ সালে জন্ম নেওয়া খালেদা একরাম ১৯৭৪ সালে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পরের বছরই প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।

১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই ইউনিভার্সিটি থেকে স্থাপত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি। ১৯৯৫ সালে পূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান দুই মেয়ে ও এক ছেলের জননী খালেদা একরাম।

খালেদা একরাম

শিক্ষক হিসাবে খালেদা একরামের স্মৃতিচারণ করে জেবুন নাসরীন বলেন, “খুবই সুন্দর পড়াতেন। উনি একজন সৎ মানুষ ছিলেন। তাই আমরা বুঝতাম, তিনি যা পড়াচ্ছেন, তা পড়ে এসে, নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াচ্ছেন।”

২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বুয়েটের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান খালেদা একরাম। তার মৃত্যুতে মঙ্গলবার ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ।

শোক পালনে আর কোনো কর্মসূচি থাকছে কি না- জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য জেবুন বলেন, “একাডেমিক কাজ যেন ব্যাহত না হয়, সেজন্য ম্যাডাম আমাদের সব সময় সজাগ থাকতে বলতেন। উনিও নিশ্চয় চাইবেন না শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটুক।

“উনি আমাদের সবসময় বলতেন, একাডেমিক সেশন ও টার্ম যেন ঠিক সময়ে শুরু করি এবং শেষ করি। উনি আসার পর একাডেমিক কার্যক্রম একদম সুন্দরভাবে চলেছে, স্বাভাবিকভাবে চলেছে। সেশনজট যেটা সেটাও একেবারে কমে এসেছে।”

দুটি কারণে অধ্যাপক খালেদা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য বলে মনে করেন তারসহকর্মীরা। 

“একদিকে তিনি ছিলেন বুয়েটের ইতিহাসে প্রথম নারী উপাচার্য। অন্যদিকে কর্তব্য পালনরত অবস্থায় অকালে চলে যাওয়া প্রথম উপাচার্যও তিনি।”

খালেদা একরাম কেমন মানুষ ছিলেন- প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন উপাচার্য কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলী আশরাফ।

“এক কথায় অসাধারণ ছিলেন তিনি। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অনেক কিছু করেছেন তিনি। আমরা তার অধস্তন হলেও সেভাবে কখনও নিজেকের অধস্তন মনে হয়নি।”

বুয়েট প্রশাসনের যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে সেখানকার শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আগের উপাচার্য চলে যাওয়ার পর দায়িত্বে আসেন খালেদা একরাম।

জ্যেষ্ঠতার দিক দিক থেকে ২৬তম খালেদা একরামের নিয়োগ হওয়ার পর এক সভায় প্রশাসনিক কাজে যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করেছিল শিক্ষক সমিতি।

তবে উপাচার্য হিসেবে খালেদা একরামের ২০ মাস মেয়াদের কাজের প্রশংসাই ঝরেছে শিক্ষক সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আতাউর রহমানের কণ্ঠে, যিনি আগের প্রশাসনবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।

অধ্যাপক আতাউর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্য বিভাগের শিক্ষক হওয়ায় তার সঙ্গে সেভাবে উঠা-বসা ছিল না। তবে উপাচার্য হওয়ার পর তার কর্মনিষ্ঠায় আমরা মুগ্ধ হয়েছি।

“সেশন ঠিক সময়ে শুরু করা এবং ঠিক সময়ে শেষ করাসহ প্রশাসনিক কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তিনি বুয়েট নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, বুয়েটের কাজেই সার্বক্ষণিক লেগে থাকতেন তিনি।”