“বেগমের বাইরে আমি কোনো দিনই কোনো কিছু করার চেষ্টা করিনি। বেগমই তো আমার সারা জীবনের কাজ,” নিজেই বলে গেছেন নূরজাহান বেগম, যাকে বাংলাদেশের নারী সম্পাদকদের পথিকৃৎ বলা হয়।
বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগে ৯১ বছর বয়সে সোমবার জীবনাবসান ঘটে নূরজাহান বেগমের। শেষ জীবনে চোখে ভালো দেখতেন না, পড়তেও পারতেন না, তবুও অন্যের মাধ্যমেই কাজ করে যেতেন বেগমের জন্য।
১৯৪৭ সালে প্রকাশ শুরুর পরপরই বাংলাদেশের নারী মহলে সমাদৃত হয় বেগম। শুধু বাংলায় নয়, উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক এটি।
বাংলার নারী জাগরণে এই পত্রিকাটির অবদান স্মরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, তার মৃত্যু জাতির জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি।
বাংলাদেশের নারী লেখকদের অনেকের হাতে খড়ি এই বেগমের মাধ্যমে। নারীদের সচেতন করে তুলতে বেগমের ভূমিকা স্মরণ করেছেন লেখক ফরিদা আখতার, যিনি নিজেও এখন সম্পাদনায় যুক্ত।
শুরুটা হয়েছিল নূরজাহানের বাবা খ্যাতিমান সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের ভাবনা থেকে। তার মেয়ে নূরজাহানের জন্ম ১৯২৫ সালে চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকা দিয়ে নাসিরউদ্দিন ততদিনে বেশ পরিচিত। ১৯১৮ সাল থেকে সওগাত বের করার পর সাহিত্য চর্চায় মেয়েদের জায়গা করে দিতে কবি বেগম সুফিয়া কামালকে দায়িত্ব দিয়ে সওগাতের মহিলা বিভাগ চালু করেন তিনি।
কিন্তু পরিসর খুবই ছোট হওয়ায় শুধু নারীদের জন্য স্বতন্ত্র একটি পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা মাথায় আসে নাসিরউদ্দিনের। আর তার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে ‘সাপ্তাহিক বেগম’ প্রকাশ শুরু হয়।
এই প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে নূরজাহান বেগম বলেন, “বাবা বললেন, বছরে একবার করে মেয়েদের লেখা, ছবি ছাপলে ওরা এগোতে পারবে না। ওদের জন্য একটা সাপ্তাহিক দরকার।”
এরপর সুফিয়া কামালকে ডেকে ভাবনার কথা বললে তার সাড়া পান নাসিরউদ্দিন।
“বাবা বললেন, ‘একটা সমস্যা, নূরজাহান তো মাত্র কলেজ থেকে বেরিয়েছে। এসময় ওকে সম্পাদিকা করা ঠিক হবে না। তোমার নামটা দিই?’ খালাম্মা (সুফিয়া কামাল) খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘আমি যতটা পারি আপনাকে সহযোগিতা করব। বের করেন’।”
নূরজাহান বেগম তখন কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেছিলেন। সুফিয়া কামালের সঙ্গে বেগমের ‘ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের’ দায়িত্ব নেন তিনি।
১৯৪৮ সালে বেগমের প্রথম ঈদসংখ্যায় ৬২ জন নারী লেখকের লেখা ছাপা হয়। সেই সঙ্গে ইমিটেশন আর্ট পেপারে ছাপা হয় নারীদের ছবি। সংখ্যাটিতে ৬২টি বিজ্ঞাপন সংস্থা বিজ্ঞাপন দেয়, যার মূল্য ছিল ২ টাকা।
ভারত ভাগের পর সুফিয়া কামাল ঢাকায় চলে এলে চার মাসের মাথায় সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হয় নূরজাহানকে। ১৯৫০ সালে নাসিরউদ্দিনও সপরিবারে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় এলে এখান থেকেই বেগম প্রকাশিত হতে থাকে, নূরজাহানের সম্পাদনায়।
ঢাকায় ফিরে রক্ষণশীল সমাজে পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা এলেও তা গায়ে লাগাননি নূরজাহান।
নারী জাগরণ, কুসংস্কার বিলোপ, গ্রামগঞ্জের নির্যাতিত নারীদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠি প্রকাশ করে গেছেন বেগমে। নিজে তেমন লিখতেন না, তবে নতুনদের লিখতে নিয়মিত উৎসাহ দিয়ে গেছেন তিনি।
দুই মেয়ের বাইরে বেগমই হয়ে উঠেছিল নূরজাহান বেগমের আরেক সন্তান। রঙিন ও ঝলমলে ছাপার এই সময়েও পুরান ঢাকার নারিন্দার পলেস্তরা ঘষা বাড়িতে বসে বেগম প্রকাশের কাজে বৃদ্ধ বয়সের অচল শরীর নিয়েও সচল ছিলেন তিনি।
এর মধ্যেই দুই মেয়ের মধ্যে বড় ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ফ্লোরা নাসরিন খান মায়ের দায়িত্ব নিয়ে বেগম সম্পাদনায় যুক্ত হন। ছোট মেয়ে রীনা ইয়াসমিন বিথীও সহযোগিতা করেন।
বিজ্ঞাপন আগের মতো আসে না, প্রচার সংখ্যাও কমে গেছে, প্রকাশও অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। তারপরও জমি বিক্রি করে ঈদ সংখ্যাটি নিয়মিত প্রকাশ করে গেছেন নূরজাহান বেগম।
বেগমের পেছনে নিজের সব কিছু দিয়ে যাওয়া এই নারী একটি চাওয়ার কথাই শুধু বলতেন, আর যাই হোক, বেগম যেন বেঁচে থাকে।