রায়ে সংসদ সদস্যদের অক্ষমতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির যুক্তি

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের ক্ষেত্রে দলের বিপক্ষে সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার অক্ষমতা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির যুক্তি দেখিয়েছে হাই কোর্ট।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2016, 05:42 PM
Updated : 8 May 2016, 03:55 PM

আস্থা ভোট ছাড়া দলের বিপক্ষে ভোট দিতে সংসদ সদস্যদের বাধা নেই বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক মত জানানোর মধ্যে হাই কোর্টের তিন বিচারককে নিয়ে গঠিত বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেওয়া রায়ে স্পষ্টতই তার বিপরীত কথা বলা হল।

সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবীর করা রিট আবেদনে বৃহস্পতিবার ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ে বলা হয়েছে, “সংসদের মাধ্যমে বিচারকগণের অপসারণ প্রক্রিয়া ইতিহাসের একটি দুর্ঘটনা।”

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় জাতীয় সংসদের উপরই ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।

জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয় একটি সামরিক ফরমানের মাধ্যমে। ওই বিধান রদ করে এই ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়।

বিভিন্ন দেশের নজির তুলে ধরে ঘোষিত রায়ে আদালত বলেছে, “আমাদের বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন।

“এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪)ও ১৪৭ (২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।”

রায় ঘোষণা করে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে রুল যথাযথ (অ্যবসলিউট) ঘোষণা করা হল...ষোড়শ সংশোধনী আইন কালারেবল, এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হল।”

ষোড়শ সংশোধনীর ভিত্তিতে গত ২৫ এপ্রিল মন্ত্রিসভায় ‘বাংলাদেশ ‍সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন হওয়ার পরদিন বিচারপতি খায়রুল হক বলেছিলেন, এসব ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের ‘ফ্লোর ক্রসিং’র বিধান প্রযোজ্য হবে না।

তার মতে, বর্তমান ৭০ অনুচ্ছেদ কেবল ‘দলের বিরুদ্ধে ভোট’, অর্থাৎ অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দলীয় মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য নয়।

তবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে আদালত বলেছে, “সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদেরকে বলতে হয়, এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের বেড়ি পরিয়ে রেখেছে। এটা তাদের উপর শক্ত বেড়ি আরোপ করেছে।

“সংসদে সংসদ সদস্যরা কোনো ইস্যুতে তাদের দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। এমনকি ভুল হলেও দলের অবস্থানকে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা তাদের নেই। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা ভোট দিতে পারেন না। দলের হাই কমান্ডের হাতে তারা জিম্মি।”

বিচারপতি অপসারণের আইনের খসড়ায় অসদাচরণের জন্য কোনো বিচারককে সরাতে সাবেক একজন বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে তদন্তের পর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তৃত্ব সংসদকে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে আইন কমিশন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

খসড়া আইন অনুযায়ী সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি সংশ্লিষ্ট বিচারকের অসামর্থ্য বা অসদাচরণের জন্য অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ওই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি তাকে অপসারণ করবেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রসঙ্গ টেনে এই সংশোধনী থাকলে কখনও কখনও প্রয়োজন হলেও কোনো বিচারককে অপসারণ অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে বলে মত দিয়েছে আদালত।

আদালত বলে, “ষোড়শ সংশোধনীর সাংবিধানিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আমরা এই দেশে বিদ্যমান অদ্ভূত রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে চোখ বুঁজে থাকতে পারি না। দেশের জাতীয় ইস্যুগুলোতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে কোনো ঐকমত্য নেই।

“বাস্তবতার নিরিখে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এক্ষেত্রে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছে। আমাদের সমাজও প্রবলভাবে বিভক্ত। সব সময় ক্ষমতায় থাকা একটা দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও থাকতে পারে। এই সব ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিয়ে সংসদীয় অপসারণ ম্যাকানিজম অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতে পারে।”

“সেক্ষেত্রে দুর্নীতি বা সক্ষমতাহীন বিচারকরা জনস্বার্থের বিপরীতে তাদের অফিস চালিয়ে যেতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে আমরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না।”

রায়ে সংবিধানের এই সংশোধনী সম্পর্কে জন-ধারণার প্রসঙ্গও টেনেছে আদালত।

কানাডার একটি দৃষ্টান্ত টেনে আদালত বলেছে, “জনগণের ধারণা এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে কর্তন করা হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় কোনো জন ধারণা এলে সেটাকে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। জনগণের অনুধাবনে যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন না থাকে, তাহলে কোনোভাবেই (স্বাধীন) থাকতে পারবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচর্চায় এবং আইনের শাসনে বিচার বিভাগের স্বাধীন থাকা আবশ্যক।”

“জনগণের অনুধাবন অনুসারে ষোড়শ সংশোধনী বিচারকদের মাথার উপরে ডেমক্লেসের তরবারির (গ্রিক পুরানের) মতো ঝুলছে,” বলেছে আদালত।