বাংলাদেশি জঙ্গিরা বিদেশের সঙ্গে ‘কানেক্টেড’ হচ্ছে: বিসওয়াল

কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে আইএস ও আল কায়দার দায় স্বীকারের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগ গড়ে ওঠার সন্দেহ করছে যুক্তরাষ্ট্র।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2016, 03:53 PM
Updated : 5 May 2016, 03:55 PM

ইউএসএআইডি কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ডে উদ্বেগ জানিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ঢাকায় আসা দেশটির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল একথা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে।

গত এত বছর ধরে লেখক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, বিদেশিসহ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস ও আল কায়দার দায় স্বীকারের বার্তা আসার পর যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলে আসছিল।

বৃহস্পতিবারের বৈঠকে বিসওয়াল এই বিষয়ে কিছু বলেছেন কি না- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “তারা বলছে, জঙ্গিরা আস্তে আস্তে বিদেশের সাথে কানেক্টেড হচ্ছে।”

সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিসওয়ালের সঙ্গে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটও ছিলেন।

সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোতে আইএস কিংবা আল কায়দার বার্তাগুলোকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা বলে আসছেন, বাংলাদেশের জঙ্গিরা ঘটনা ঘটিয়ে ইন্টারনেটে এসব বার্তা ছড়াচ্ছে।

বিসওয়ালের সঙ্গে বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে থাকা আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক দুদিন আগেও বলেছিলেন, বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিরা ‘হাই-ফাই ক্রিমিনাল’ না যে তাদের ‘ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন’ থাকবে।

বিসওয়াল সন্দেহ প্রকাশের পর কী বলেছেন- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “তাদের বলেছি, এ ধরনের কানেকশনের সূত্রপাত যখনই আমরা পেয়েছি তখন আমাদের গোয়েন্দারা তাদের শনাক্ত করেছে এবং যারা লিংক নিয়ে প্রচার করতে এসেছিল, দু’চারজনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি।”

নিশা দেশাই বিসওয়াল

বিসওয়াল সাংবাদিকদের বলেন, “আইএস, আল কায়েদার মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এখানকার বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনায় যে দায়িত্ব স্বীকার করে আসছে, সেটিকে আমরা বিবেচনায় নিয়ে থাকি।

“কারণ, এসব সংগঠন হয় সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাচ্ছে কিংবা এখানকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটা যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”

বাংলাদেশে সন্ত্রাসী সংগঠন যাতে ঘাঁটি গাঁড়তে না পারে, সেজন্য ঢাকার সঙ্গে ওয়াশিংটন একসঙ্গে কাজ করবে বলে তিনি জানান।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা জুলহাজ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহযোগিতা করতে চেয়েছে ওয়াশিংটন। হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে বিসওয়ালকে বাংলাদেশে পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।

সহযোগিতার বিষয়ে আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, “আমরা তাদের কাছে টেকনিকাল সহযোগিতা চেয়েছি, আমরা চেয়েছি কাউন্টার টেররিজম ইউনিটির অফিসারদের ট্রেইনিং দেওয়ার জন্য। এতে তারা রাজি হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, অফিসারদের ট্রেইনিং দেওয়ার জন্য তাদের লোকজন আসছে।”

বিসওয়াল বলেন, জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যেখানে সহযোগিতা করার সুযোগ আছে, সেখানে তারা তা করতে তৈরি।

ভিন্ন মতের মানুষদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের মধ্যে বিসওয়ালকে বাংলাদেশ পুলিশের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে জানিয়েছেন আসাদুজ্জামান কামাল।

“আমাদের পুলিশ যথাসাধ্য কাজ করছে, যতগুলো ঘটনা ঘটছে প্রায় সবগুলোর চার্জশিট (পুলিশের হিসাবে ৩৭টির মধ্যে ৬টিতে) দিয়েছি। যতগুলো বাকি রয়েছে, তা শিগগির শেষ করতে পারব বলে আমরা তাকে জানিয়েছি।”

সন্ত্রাসীদের হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগাম তথ্য থাকলে তা দিতে বিসওয়ালের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাড়া পেয়েছেন বলে আসাদুজ্জামান কামাল জানান।

এক ইতালীয় ও এক জাপানি হত্যার পর জুলহাজকে হত্যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত করার উদ্দেশ্য ছিল কি না, তা জানতে চান বিসওয়াল।

“আমরা তাদের স্পষ্ট করে বলেছি, এ হত্যাকাণ্ডগুলো যারা করছে, তা অন্য ধরনের হত্যাকাণ্ড। তা আমরা শনাক্ত করেছি। এগুলো বিদেশিদের করার জন্য হত্যাকাণ্ড নয়,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

বাংলাদেশকে ‘অকার্যকর রাষ্ট্রে’ পরিণত করার উদ্দেশ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির জন্য এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে বলে ‍যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী মন্ত্রীকে জানিয়েছেন আসাদুজ্জামান কামাল।

‘ফ্রিডম অফ স্পিচ’ আছে, তবে

বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেছেন, তবে কোনো ধর্মের উপর আঘাত দিয়ে লেখা সরকার সহ্য করে না।

সমকামিতার বিষয়ে ধর্ম ও সমাজে ‘নিষেধ’ আছে জানিয়ে তার বিরোধিতাও করেছেন তিনি।

বাংলাদেশে ব্লগে যারা লেখেন তাদের ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ’ আছে কি না, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চান বিসওয়াল।

এর জবাবে তাকে আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, “আমরা তাদের স্পষ্টভাবে বলেছি, আমাদের দেশে এ পর্যন্ত ২২টি টিভি চলছে। ১২শ’র বেশি পত্রিকা বের হচ্ছে। যেগুলোর মধ্যে আমাদের কোনো কন্টোল নেই। যা খবর হচ্ছে, তা ছেপে দেওয়া হচ্ছে।

আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল

“আমরা বলেছি, অনেক ব্লগার ব্লগে লেখেন। দু’একজন ব্লগার যে সমস্ত কথা লেখেন, ধর্মের বিপক্ষে লেখেন, যেগুলো আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে নিষেধ আছে। সব মানুষ এখানে যার যার বিশ্বাস, যার যার ধর্ম নিয়ে থাকবে।কোনো বিশ্বাস, কোনো ধর্মের উপর এখানে আঘাত করতে পারবে না। এটা ক্রিমিনাল অফেন্স।”

ব্লগে লেখালেখি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্য তুলে ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীর সেই মেসেজ আজকেও দিতে চাই যে তাদের (ব্লগার) লেখায় সংযত হওয়া উচিত। কোনো ব্লগ লেখক এ ধরনের  লিখে দেশকে একটা পরিস্থিতির শিকার করবে, সেটা আমরা হতে দেব না।”

জুলহাজ মান্নান সমকামীদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। সমকামী ও হিজড়াদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রূপবান নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।

এর বিরোধিতা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আন -নেচারাল সেক্সের যে একটা আন্দোলন সৃষ্টি করার প্রয়াস পাচ্ছে। এটা আমাদের ধর্মে, আমাদের সমাজে নিষেধ রয়েছে। এটা একটা ক্রিমিনাল অফেন্সও বটে।”

এই যদি হয় সরকারের অবস্থান, তাহলে রূপবানের প্রকাশনা বন্ধ করা হয়নি কে- এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেন, “পত্রিকাটি যখন বের হয়, তখন তো তারা বলেনি যে তারা এই ধরনের লিখবে। এখন লিখছে, আমরা এগুলো বন্ধ করব।”

গত মাসে বাংলা নববর্ষে সমকামী অধিকারকর্মীদের মিছিলে বাধা দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “পহেলা বৈশাখ তাদেরকে আমরা বলেছি, তারা যেন মিছিল বের না করে। তাদের মিছিল করার কথা ছিল। পুলিশ তাদের বাধা দিয়েছিল। সেজন্য কোনো ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।”

আসাদুজ্জামান কামাল দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী মন্ত্রীও বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান বুঝেছেন। হত্যাকারীরা উৎসাহ পায়, এমন কিছু করা এড়ানোর বিষয়টি তিনি মেনে নিয়েছেন।

“তবে আমরা বলছি, যে আমরা সবাইকে প্রটেকশন দিচ্ছি। সে অপরাধ করুক, আর নাই করুক। সে দেশি হোক কিংবা বিদেশি হোক। সে যে কোনো ধর্মের বা যে কোনো বর্ণের হোক। সবাইকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।