ষোড়শ সংশোধন নিয়ে হাই কোর্টের রায় সংবিধান পরিপন্থি: আইনমন্ত্রী

বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে আনতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে দেওয়া হাই কোর্টের রায়কে ‘সংবিধান পরিপন্থি’ বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2016, 11:21 AM
Updated : 5 May 2016, 02:36 PM

বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের রায় ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর বিকালে সংসদ অধিবেশনে এক অনির্ধারিত আলোচনায় এই প্রতিক্রিয়া জানান তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনিসুল হক বলেছেন, সংসদের সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে দেওয়া এই রায় আপিল বিভাগে টিকবে না। রাষ্ট্রপক্ষ এখন আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

“আমরা আইনি পথেই যাব। আমরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করব না,” একইসঙ্গে বলেন তিনি।

উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়।

ওই সংশোধন চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবীর একটি রিট আবেদনের রায়ে বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের তিন বিচারপতির একটি বেঞ্চ সংসদের ওই পদক্ষেপকে অবৈধ বলে রায় দেয়।

আদালতের এই আদেশ নিয়ে সংসদ অধিবেশনের শুরুতেই পয়েণ্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম।

পরে আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ এবং জাসদের মইন উদ্দিন খান বাদল।

বাদল প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, “সার্বভৌমত্ব জনগণের। সেই সার্বভৌমত্বের এক্সপ্রেশন হচ্ছে এই সংসদ। জনগণের প্রতিনিধি। এটা আপনি জানেন না, এটা আমি মনে করি না।”

তারা আদালতের রায়ের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন। এসময় সংসদে ছিলেন না সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সংসদ সদস্যদের দাবির মুখে আইনমন্ত্রী বলেন, “আমরা সংশোধনীটা পাস করেছিলাম বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য, বিচারপতি-বিজ্ঞ বিচারকদের সন্মান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য।

“আর্টিকেল ৯৬ এ সংশোধনীর আগে যেটা ছিল, তা হল মার্শাল ল ফরমান দ্বারা তৈরি। ১৯৭৮ এর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। আমরা সেটা পরিবর্তন করতে গিয়েছিলাম।”

“উনারা (হাই কোর্ট) সেটা আজকের রায়ে বলে দিলেন, এটা ‘ইলিগ্যাল’। এখনও আমি বলি এটা মোটেও ইলিগ্যাল নয়। উনারা যেটা বলছেন সেটা নট মেইনটেনেবল।”

১৯৭২ সালে মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের উপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।

জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয় একটি সামরিক ফরমানের মাধ্যমে।

এই সংশোধনের বিরোধিতাকারীদের পক্ষে আদালতে শুনানিতে বলা হয়েছিল, এই পরিবর্তন হয়েছে সংবিধানের ‘মৌল কাঠামোকে পরিবর্তন’ করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মূল কাঠামো। যেহেতু ‘মূল কাঠামো পরিবর্তন’ করা হয়েছে, সেহেতু ষোড়শ সংশোধনী ‘সংবিধান পরিপন্থি’।

আনিসুল হক বলেন, “আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। এখনও বিশ্বাস করি বিচার বিভাগ স্বাধীন।

“আপিল করলে এই রায় গ্রহণযোগ্য হবে না। সেজন্য আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আগামী রবি-সোমবারের মধ্যে আপিল করব।”

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

আইনমন্ত্রী বক্তব্য দেওয়ার সময় বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় পার্টির এ কে এম মাঈদুল ইসলাম ও কাজী ফিরোজ রশীদ নিজের আসন থেকে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুরু করেন।

স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী তাদের বসতে কয়েকদফা অনুরোধ করলেও আইনমন্ত্রী আপিলের কথা বলার প্রতিক্রিয়ায় তাজুল মাইক ছাড়াই বলেন, “আমরা কেন আপিল করব।”

আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আসরের নামাজের বিরতিতে যান স্পিকার। বিরতির পর জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বক্তব্য দিতে চাইলে শিরীন শারমিন তাকে ফ্লোর দেননি।

এর পর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম ফ্লোর চাইলে স্পিকার তাকে কথা বলার সুযোগ দেন।

সেলিম বলেন, “সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে কোথা থেকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বিচারপতিরা মনগড়া রায় দেন, এটা ভাবতে অবাক লাগে। এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না, তা আমাদের খুঁজে দেখতে হবে।

“রাষ্ট্রপতির বিচার যদি এই সংসদ করতে পারে, তাহলে বিচারপতিরা কোথা থেকে ওখানে বসেছেন। এই সংসদই তো আইন পাস করে তাদের বসিয়েছেন। আইন বহির্ভূত কোনো বিচার করার জন্য বসানো হয়নি। এই সংসদে উনাদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির আইন এসেছে। আমরা যদি এটা পাস করে না দিই, তাহলে উনারা কি তা পাস করাবেন?”

“এই সংসদকে অকার্যকর ও জনগণের শক্তিকে নস্যাৎ করার জন্য কোনো অশুভ শক্তি আইনের দোহাই দিয়ে আইন বহির্ভূত কাজ করছে। যারা এটা করছে, তাদের বিচারের জন্য সংসদ থেকে আইন করা উচিৎ। যারা সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ করে তারা পাকিস্তানে চলে যায়। সংবিধানের দাড়ি কমা সেমিকোলন বাদ দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। তাদের সংশোধিত হয়ে কাজ করতে হবে। আপনারা বাড়াবাড়ি করে অশুভ শক্তির সাথে হাত মেলালে জনগণ আপনাদের ক্ষমা করবে না,” বলেন ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা।

এরপর সুযোগ পেয়ে প্রতিমন্ত্রী চুন্নু বলেন, “ভারত, অস্ট্রেলিয়া বা অন্যান্য দেশে যদি ইমপিচমেন্ট থাকতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের সংসদে সেটা কি থাকতে পারবে না?”

এরপর দিনের কার্যসূচি অনুযায়ী বিচারকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করতে গেলে সংসদ সদস্যদের বিরোধিতার মুখে পড়েন আইনমন্ত্রী।

তখন তিনি সংসদ সদস্যদের আশ্বস্ত করে বলেন, “হাই কোর্টের এই রায় সংবিধান পরিপন্থি। আপিল করলে এই রায় গ্রহণযোগ্য হবে না।”

পরে স্পিকার-ডেপুটি স্পিকারের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিলটি জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাবে কথা বলতে গিয়ে জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, “যেভাবে বিচারপতিদের সব কিছু মেনে নিচ্ছেন, কবে না আবার কোনো অসিলায় বলে বসে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করতে হবে।”