প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের খবর প্রায়ই আসছে। পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বাংলাদেশে যে সব গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েছে, পাঁচ বছরেরও বেশি সময় সেগুলোর মান পরীক্ষা হয়নি।
এরপরেও দেশে প্রায় আড়াই লাখ গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার উদ্যোগ নেই, যদিও সেগুলোর অধিকাংশেরই মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই।
আর সব মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার এতোটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে যে সেগুলোকে ‘শক্তিশালী বোমা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ১৮৮৪ সালের বিস্ফোরক আইন অনুযায়ী ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারকে বোমা হিসাবে বিবেচনা করেন তারা। তাই আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর সিলিন্ডারগুলো পরীক্ষণের নির্দেশ রয়েছে।
“২০০০ সালের পর থেকে তিন লাখেরও বেশি গাড়ি সিএনজিতে চলার উপযোগী করে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার সিলিন্ডার পরীক্ষা করা হলেও বাকি আড়াই লাখ সিলিন্ডারই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রাস্তায় ঘুরছে।”
তাদের তথ্য, রাস্তায় প্রায় তিন লাখ সিএনজিচালিত যানবাহন থাকলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিরাপত্তা সনদ নিয়েছে মাত্র ৬০ হাজার। বাকি প্রায় আড়াই লাখ গাড়ির ক্ষেত্রে ঝুঁকির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
আরপিজিসিএল’র মনিটরিং বিভাগের ব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল্লাহ কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিন হাজার পিএসআই চাপ সহ্য করার সক্ষমতা সিলিন্ডারের আছে কি না সে বিষয়টি পাঁচ বছর পর পর পরীক্ষার নিয়ম রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। কিন্তু পরিবহন মালিকরা এক্ষেত্রে উদাসীন। গাড়িতে সিলিন্ডার বসানোর পর ৮/১০ বছর ধরে পুনঃপরীক্ষণ করা হয়নি এমন বহু গাড়ি রাস্তায় চলছে।
এসব গাড়ি মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্ক করেন এই প্রকৌশলী।
পুনঃপরীক্ষণ কী?
>> বার বার প্রসারণ ও সংকোচনের ফলে একটা পর্যায়ে সিলিন্ডারের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়। সিলিন্ডার স্থিতিস্থাপকতা হারিয়েছে কি না পুনঃপরীক্ষার মাধ্যমে সেটি দেখা হয়।
>> ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল্লাহ কবির জানান, সাধারণত গ্যাস ভরা অবস্থায় সিলিন্ডারগুলোতে ৩০০০ পিএসআই চাপ থাকে। আর পরীক্ষাকেন্দ্রে ৪৫০০ পিএসআই চাপ প্রয়োগ করে দেখা হয় সিলিন্ডার তা সহ্য করতে পারে কি না। সেই পরীক্ষায় টিকে গেলে সিলিন্ডারটি আরও পাঁচ বছরের জন্য ছাড়পত্র পায়।
>> গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার জন্য সারা দেশে ১১টি কেন্দ্র রয়েছে। সরকারি আরপিজিসিএলের দুটি কেন্দ্র ছাড়াও নাভানা, সাউদার্ন, ইন্ট্রাকো ও ইউনাইটেডের দুটি করে পরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া সিলেটে আছে ইঞ্জিনিয়ার্স সিলিন্ডার রিটেস্টিং সেন্টার নামের একটি পরীক্ষাগার।
>> আরপিজিসিএলের তথ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৫৪ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করা হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বহু হতাহতের ঘটনায় সেই হুঁশিয়ারির সত্যতাও মিলেছে। এসব দুর্ঘটনার পরও সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষণের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি সিএনজি চালিত পরিবহনের মালিকরা।
পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে বাংলাদেশে যানবাহনে সিএনজির ব্যবহার শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে। পেট্রোল ও ডিজেল চালিত ইঞ্জিনগুলোকে সিএনজিতে চালানোর উপযোগী করতে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয় আরপিজিসিএল।
যথা সময়ে সিলিন্ডার ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য সারাদেশে আরপিজিসিএল’র দুটি পরীক্ষাগারসহ মোট ১১টি পরীক্ষাগার রয়েছে। কিন্তু সিলিন্ডার পরীক্ষার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় গাড়ির মালিকদের তেমন মাথাব্যথা দেখা যায় না।
দেখারও কেউ নেই
১৯৮৩ সালের সড়ক পরিবহন অধ্যাদেশ অনুযায়ী সড়ক পথে চলাচলকারী পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেলচালিত যানবাহনগুলোর ফিটনেস সনদ, রুট পারমিটসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় তদারক করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ।
তার কথায় এটা স্পষ্ট পেট্রোল ইঞ্জিন অথবা ডিজেল ইঞ্জিনের যানবাহনগুলো সিএনজিতে রূপান্তরিত হলে তা কতটুকু নিরাপদ সেটা বিআরটিএ দেখে না।
“সিএনজিতে কনভার্সনের ক্ষেত্রে শুধু সিলিন্ডার নয়, নজল পাইপ, সেইফটি ভাল্বসহ আরও কিছু যন্ত্রাংশ ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত হয়। নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবতে হলে সবগুলো বিষয়কেই পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। কিন্তু আইন অধ্যাদেশে না থাকলে এতগুলো কাজ কীভাবে সম্ভব?,” প্রশ্ন রাখেন বিআরটিএর প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীন আরপিজিসিএলের গ্যাস সিলিন্ডার দেখভাল করার কথা।
এক্ষেত্রে বিআরটিএর সঙ্গে আরপিজিসিএলের তথ্য বিনিময় হয় না বলে জানান তিনি।
অপরদিকে আরপিজিসিএলের প্রকৌশলী সাইফুল্লাহ কবির বলেন, কোনো পরীক্ষায় ব্যবহার অনুপযোগী হলেই কেবল তারা সিলিন্ডার জব্দ করেন। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারবাহী কোনো যানবাহন জোর করে ধরে এনে পরীক্ষা করার সুযোগ তাদের নেই।
সিলিন্ডারে জোড়াতালি?
সম্প্রতি দেশের একাধিক স্থানে সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে বেশ কয়েকজন হতাহতের পর সিলিন্ডারের নিরাপত্তা ও এতে কারসাজি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
গত ১৪ এপ্রিল আশুলিয়ার ডেল্টা সিএনজি ফিলিং স্টেশনে একটি প্রাইভেটকারে সিএনজি গ্যাস পূর্ণ করার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে গাড়ির মালিকসহ দুইজন নিহত হন।
ওই ঘটনার তদন্তকারী আশুলিয়া থানার এসআই আবু হেনা মো. মোস্তফা রেজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিলিন্ডারের ভগ্নাংশ দেখে মনে হচ্ছে এতে জোড়া দেওয়া হয়েছিল। গাড়ির মালিকের মৃত্যু হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্তারিত জানা যায়নি।”
সারাদেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় আড়াইশ কেন্দ্রে পেট্রোল ও ডিজেল ইঞ্জিনকে সিএনজিতে রূপান্তরিত করার অনুমোদন রয়েছে আরপিজিসিএলের। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের আড়ালে কিছু অসাধু লোক মাত্র ৪০/৫০ হাজার টাকায় যানবাহনকে সিএনজিতে রূপান্তরিত করে দিচ্ছে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে অক্সিজেন সিলিন্ডার বদলে নিয়ে বা কম দামী সিলিন্ডার এমনকি জোড়াতালি দেওয়া সিলিন্ডারও গাড়িতে বসানো হয় বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে অভিযোগ করেছেন।
“বিদেশ থেকে আমদানি করা সিলিন্ডারগুলো উচ্চ তাপমাত্রা ও হাইড্রোলিক চাপ সহনীয় করে তৈরি করা হয়। সেখানে জোড়া থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্ঘটনার শিকার সিলিন্ডারে জোড়া দেওয়ার আলামত দেখা যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
তবে এভাবে জোড়াতালি দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার তৈরি করা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রকৌশলী সামসুল আলম।
“সিলিন্ডারে জোড়াতালি দেওয়া প্রায় অসম্ভব। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে এতে এমনিতেই বিস্ফোরণের ঝুঁকি দেখা দেয়,” বলেন তিনি।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “সম্প্রতি যেসব গাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটছে সেগুলো এর আগে কয়েকবার হাতবদল হওয়া। এগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছিল বহু আগে।
“ফলে তারা কোনো কোম্পানি থেকে সিলিন্ডার কিনেছিল? নাকি অক্সিজেন সিলিন্ডার বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহৃত সিলিন্ডার জোড়াতালি দিয়ে নতুন গ্যাস সিলিন্ডার বানিয়েছে, তা উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।”