জুলহাজ-তনয় খুনের তদন্ত এখনও সন্দেহে ঘুরপাক

জঙ্গি দমনে নিজেদের ‘রোড মডেল’ দাবি করলেও জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহেও তদন্তে অগ্রগতির কোনো খবর দিতে পারেনি পুলিশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2016, 08:35 AM
Updated : 3 May 2016, 04:47 PM

সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত নিয়ে পুলিশের সমালোচনার প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এসে পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক খুনিদের বিষয়ে এখনও সন্দেহের কথাই জানিয়েছেন।

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমকে এই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহের কথা জানিয়ে তা মনে করার কারণ তিনি দেখিয়েছেন এভাবে- “অতীতে খুনের পর যেভাবে সাইট ইন্টেলিজেন্সে ‘দায় স্বীকার’ করে বার্তা এসেছে, আর কর্মকৌশল দেখেই মনে হচ্ছে এই জোড়া খুন আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ঘটিয়েছে।”

গত বছর এবং চলতি বছরে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এবং আল কায়দার নামে দায় স্বীকারের বার্তা এলেও বরাবরই পুলিশ তা ভুয়া বলে উড়িয়ে দিয়ে আসছে।

আইএস নেই কীসের ভিত্তিতে বলছেন- জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা কেউ বলেনি যে তাদের সঙ্গে আইএসের কোনো সম্পর্ক আছে। আর গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিরা হাই-ফাই ক্রিমিনাল না যে তাদের ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন থাকবে।”

এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে পুলিশের ব্যর্থতার সমালোচনার জবাবে শহীদুল ৩৭টি খুনের মধ্যে ৩৪টির কারণ উদ্ঘাটনের একটি প্রতিবেদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন।  

“যারা পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলেন, যারা বলেন, পুলিশ পারতেছে না, তাদের জন্য এই প্রতিবেদন যে ৩৭টি ঘটনার মধ্যে ৩৪টি ঘটনার কারণ সুন্দরভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশ পুলিশের ব্যর্থতা এখানে নেই। এটাই আমার কথা,” বলেন তিনি।

শহীদুল আরও বলেন, “তারপরও সব সময় যে কথা বলা হয়, এই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সরকার, প্রশাসন, পুলিশ তেমন কোনো ভূমিকা নিয়ে পারে না। আমাদের অর্জনকে তুলে ধরা হয় না। বরং আমাদের ব্যর্থতা তারা তুলে ধরে।

“কিন্তু আমরা দাবি করছি যে, অনেক শক্তিশালী দেশের তুলনায় জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ পুলিশ বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত।”

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার বাইরে লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার পর অন্তত চারজন ব্লগার,অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া দুজন বিদেশি, কয়েকজন পুরোহিত এবং যাজকের পাশাপাশি আক্রান্ত হন শিয়া, আহমদিয়ারাসহ উদার সুন্নিরাও।  

এই বছরএপ্রিলে অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীর পর গত ২৫ এপ্রিল খুন করা সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ ও তনয়কে।

তার আগে ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনের পর অন্তত দুজন ব্লগার খুন হন। হামলা হয় ব্লগার আসিফ মহীউদ্দীনের উপরও।

জুলহাজ ও তনয় হত্যাকাণ্ডের পর আশপাশের ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে কয়েকজন খুনিকে চিহ্নিতের কথা পুলিশ কর্মকর্তারা জানালেও এক সপ্তাহে কোনো খুনিকে শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার করা যায়নি।

গত ৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলের গোপালপুরে দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দার এবং তার আগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যাকাণ্ড জেএমবির কাজ বলে দাবি করেন পুলিশ প্রধান শহীদুল।

৬টিতে অভিযোগপত্র, গ্রেপ্তার ১৪৪

পুলিশ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি শহীদুল ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত জঙ্গি হামলার ঘটনায় ৩৭টি মামলার তথ্য তুলে ধরেন।

এতে বলা হয়, তদন্ত শেষে ছয়টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ১৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের ৪৯ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ প্রধান বলেন, “কোনো ভুল লোককে ধরা হয়নি। তদন্ত করে সঠিক অপরাধীকে ধরা হয়।”

আইজিপির দেওয়া প্রতিবেদনে অধিকাংশটি মামলার ক্ষেত্রে ‘মূল ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে’, ‘বর্তমানে তদন্তাধীন’ উল্লেখ করা রয়েছে।

জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয়ের লাশ

তিন বছরের ৩৭ মামলায় মাত্র ছয়টিতে অভিযোগপত্র কম নয় কি- জানতে চাইলে শহীদুল বলেন, “চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হলে অনেক খুঁটিনাটি তদন্ত করতে হয় তাই কিছু সময় লাগছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সব ঘটনা রোধ করতে পারিনি। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তদন্ত করে সেই জঙ্গিগোষ্ঠী, যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, তাদেরকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি।”

তিনি বলেন, “৩৭টি ঘটনার মধ্যে জেএমবি ঘটিয়েছে ২৫টি, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ঘটিয়েছে ৮টি আর অন্য সন্ত্রাসী বা জঙ্গি গোষ্ঠী দ্বারা বাকি চারটি ঘটনা ঘটেছে।”

কিছু কিছু ঘটনায় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান পুলিশ প্রধান।

জঙ্গিদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত ১৫টি পিস্তল, একটি এসএমজি, একটি একে ২২ রাইফেল, ৪৬১টি গুলি, ৯১টি গ্রেনেড, ১৬টি বোমা, ১৬টি চাপাতি এবং ল্যাপটপ ও মোটরসাইকেল উদ্ধারের কথা জানান তিনি।

সমস্যা ‘বৈশ্বিক’

জঙ্গিবাদকে বৈশ্বিক সমস্যা উল্লেখ করে তা মোকাবেলার জটিলতা তুলে ধরেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক।

“এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। এটা বৈশ্বিক সমস্যা। আমি মনে করি, মানসিক বিকৃতি ছাড়া জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হতে পারে না। সোশাল মিডিয়াসহ বিভিন্নভাবে জঙ্গিরা উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হয়। এছাড়াও নিজেদের মধ্যে মোটিভেশনাল বয়ান করে। এভাবে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।”

পুলিশ প্রধান বলেন, ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়।

“২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে ২৩ জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা হয়েছে। সেটাও বিশেষ মহল কর্তৃক জঙ্গিদের দ্বারা করা হয়েছে।”

ধর্মের খণ্ডিত ব্যাখ্যা কিংবা অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদীরা প্রচার চালানোয় মানুষকে সচেতন করে তুলতে আলেমদের সহযোগিতার প্রযোজনও তুলে ধরেন তিনি।

“যেহেতু ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ করা হয়। তাই ধর্মীয় পণ্ডিত, আলেম-ওলামার সহযোগিতা চাই।”

পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা জনগণের সহযোগিতা নিয়ে জঙ্গিদের দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে বলে দাবি করেন পুলিশ প্রধান।

“জঙ্গিবাদ যদি ঘরে ঘরে তৈরি হয়, গোপনে গোপনে, টার্গেট কিলিং হয়। তবে পুলিশ তৎপর বলেই ওইভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। সকলের সম্মিলতভাবে এগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে।”

আইজিপি দাবি করেন, বাংলাদেশে যত অপরাধ ঘটছে, তার ৯০ শতাংশেই পুলিশ রহস্য উদ্ঘাটন করতে পেরেছে।