নিজামীর রিভিউ রায় বৃহস্পতিবার

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) যে আবেদন জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী করেছেন, তার রায় জানা যাবে বৃহস্পতিবার।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2016, 06:32 AM
Updated : 5 May 2016, 05:26 AM

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ বেলা সাড়ে ১১টায় এই রায় ঘোষণা করবে। 

বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

মঙ্গলবার প্রায় আড়াই ঘণ্টা রিভিউ শুনানির পর এই আপিল বেঞ্চ রায়ের জন্য বৃহস্পতিবার দিন রাখে।

রিভিউ শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আমি মৃত্যুদণ্ড বহাল চেয়েছি। আমি আদালতে বলেছি, যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তিনটি চার্জে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। চার্জ তিনটিতে স্পষ্টভাবে আদালত মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছে। সুতরাং এই রায় পুনর্বিবেচনার অবকাশ নেই।”

অন্যদিকে তিনটি অভিযোগের পক্ষে প্রসিকিউশন থেকে দেওয়া সাক্ষ্য-প্রমাণ ‘দুর্বল’ দাবি করে নিজামীর কৌঁসুলি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, “এ সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না। আশা করছি, আমরা ন্যায় বিচার পাব।”

মৃত্যুদণ্ড বহালের রায়ের পর যুদ্ধাপরাধী নিজামীর শেষ আইনি সুযোগ এই রিভিউ আবেদন। এ আবেদনে রায়ের কোনো পরিবর্তন না হলে তার সামনে কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ থাকবে।

এর আগে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন একদিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

এরপর যুদ্ধাপরাধের দায়ে গতবছর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করে দেন বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

নিয়ম অনুযায়ী, রিভিউ নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকর করা যায় না। রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে যাবে এবং কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করবে।

বিচার পরিক্রমা

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাবনায় হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

চলতি বছর ৬ জানুয়ারি আপিল আংশিক মঞ্জুর করে সেই ফাঁসির রায়ই বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত। ১৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে, পরদিন তা পড়ে শোনানো হয় যুদ্ধাপরাধী নিজামীকে। 

এরপর ২৯ মার্চ আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করেন একাত্তরের বদর প্রধান নিজামী।

জামায়াত আমিরের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, সঙ্গে ছিলেন এস এম শাহজাহান।

রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি উপস্থাপন করেন, সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ।

ট্রাইব্যুনাল

আপিল বিভাগ

# ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রসিকিউশনের আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে আটটিতে নিজামীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

# এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় আসে।

#১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে জামায়াত আমিরকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

# চূড়ান্ত রায়ে ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে হত্যা, ধর্ষণ ও বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল থাকে।

# যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বহাল রাখা হয় ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে।

# ১, ৩  ও ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ।

মৃত্যুদণ্ড বহাল চেয়েছি: অ্যাটর্নি জেনারেল

শুনানির পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, যেসব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে নিজামীকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তা ‘বিশ্বাস করা যায় না’ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়েও তাকে অভিযুক্ত করা যায় না বলে আসামিপক্ষ দাবি করেছে।

“রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলেছি, তার যে প্ররোচনামূলক বক্তব্য এবং আল-বদরের ওপরে তার যে লেখা ৭১ সালের নভেম্বর প্রকাশিত হয়েছিলো, এর পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। তাছাড়া যারা সাক্ষী, তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল- যখন একজন ডাক্তারকে ধরে নেওয়া হয়, তার স্ত্রীর কাছে তখন আল বদররা বলেছিল- ‘মতিউর রহমান নিজামীর নির্দেশে’ তারা তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

“তাছাড়া অন্য দুটি চার্জ... ওই সময় পাবনার দুটি জায়গায় গণহত্যা চালানো, যেখানে মতিউর রহমান নিজামী উপস্থিত ছিলেন। এসব কারণে প্রত্যক্ষ সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তারা দেখেছেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত পাক বাহিনীর সাথে... সুতরাং এই রিভিউ করার কোনো অবকাশ নেই।”  

আসামিপক্ষ কোন কোন অভিযোগ থেকে খালাস চেয়েছিল জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, যে দুটি অভিযোগে নিজামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দেননি।

“তাদের সাবমিশনে যা বুঝলাম, মৃত্যুদণ্ড থেকে আপাতত অব্যাহতি চায়।”

‘ন্যায় বিচার’ হবে, আশা খন্দকার মাহবুবের

শুনানির পর নিজের চেম্বারের সামনে খন্দকার মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, “যে তিনটি অভিযোগে তাকে (নিজামী) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, আমরা বলেছি, যে সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রসিকিউশন থেকে দেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত দুর্বল। এ সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না।

“বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে ডা. আলীম ও আজহারের স্ত্রীর যে বক্তব্য (নিজামীর আদেশে ধরে নেওয়া), ওই কথা দীর্ঘ ৪০ বছর তারা বলেননি। এমনকি মামলার তদন্তের সময় তদন্ত কর্মকর্মতাকেও বলেননি। হঠাৎ করে তারা কথাগুলো বলেছেন, শেখানো কথা। এই কথার ওপর ভিত্তি করে তাকে চরমদণ্ড দেওয়া যায় না।”

খন্দকার মাহবুব বলেন, “আমরা আশা করছি ন্যায় বিচার, ন্যায় বিচার হবে। সর্বোচ্চ আদালত যে বিচার করবে- সেটাই ন্যায় বিচার। তারপর ভবিষ্যত প্রজন্ম ইতিহাস বিচার করবে- সঠিক ছিল কি না।”

যে তিন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড

অভিযোগ-২: একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে  ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।

অভিযোগ-৬: নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে যায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।

অভিযোগ-১৬: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির  বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।

জামায়াত আমির নিজামী একাত্তরে ছিলেন দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নাজিমে আলা বা সভাপতি এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আল বদর বাহিনীর প্রধান।

স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে এ মামলার বিচারে উঠে আসে।

৭২ বছর বয়সী নিজামী হলেন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা তৃতীয় ব্যক্তি, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে যার সামনে অপেক্ষা করছে ফাঁসির দড়ি।

বিগত চার দলীয় জোট সরকারের এই মন্ত্রী চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলারও মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে মোট ছয়জনের আপিলের নিষ্পত্তি শেষে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়ে রিভিউয়ের পর্যায়ে এল।