কথিত সম্মানী না পেয়ে দুই সরকারি কর্মকর্তার আক্রোশ

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ভবন নির্মাণ প্রকল্পের তদারকির জন্য কথিত সম্মানী না পেয়ে দুই সরকারি কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2016, 07:41 PM
Updated : 30 April 2016, 09:42 PM

দুই দফায় দুই বছর মেয়াদ বাড়ায় ৮৬ কোটি ৩৬ লাখ ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই প্রকল্পের কাজ আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা।

মাত্র দুই মাস বাকি থাকতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের যুগ্ম-প্রধান স্বপন কুমার ঘোষ ও উপ-প্রধান ওমর মো. ইমরুল মহসিন ‘মধ্যবর্তী মূল্যায়নের জন্য সম্মানী হিসেবে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন বলে উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েকউজ্জামান অভিযোগ করেছেন।

তা না হলে তারা এই প্রকল্পের শেষ কিস্তির ১৬ কোটি টাকা ছাড় না করার হুমকি দেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

উপাচার্য শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রকল্পের দুই মাস বাকি থাকতে মধ্যবর্তী মূল্যায়ন হওয়াটা স্বাভাবিক বিষয় নয়। সম্মানী বাবদ যে ১০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে সে ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।

“স্বপন বাবুর সঙ্গে কাল (শুক্রবার) আমার আলোচনা হয়েছে যে, বিষয়টি নিয়ে সচিব মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা নেব। সচিব মহোদয়ের নির্দেশনা মোতাবেক এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

তাদের দাবি অনুযায়ী ১০ লাখ টাকা দেবেন কি না সে বিষয় নির্দেশনা চেয়ে শিক্ষা সচিবকে চিঠিও পাঠাবেন বলে জানান ফায়েকউজ্জামান।

ওই কর্মকর্তা শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবকে না জানিয়ে প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবে (আরডিপিপি)মধ্যবর্তী মূল্যায়ন বাবদ বিবিধ খরচ থেকে ১০ লাখ টাকা সম্মানী হিসেবে দেওয়ার বিষয়টি কৌশলে যুক্ত করেন বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল মান্নানকে ফোন করে তারা ১০ লাখ টাকা ‘রেডি’ রাখতেও বলেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান।

ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, দাবি অনুযায়ী তাদের টাকা না দেওয়ার সোমবারের (২ মে) মধ্যে নগদ ১০ লাখ টাকা ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

“তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে জানান, এই টাকা না দিলে প্রকল্পের শেষ কিস্তির ১৬ কোটি টাকা ছাড় করবেন না। এছাড়া সামনে অন্য প্রকল্পও আটকে দেবেন।”

এই প্রকল্পের কার্যক্রম তদারকিতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন পরিচালক আব্দুল মান্নান বলেন, সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রকল্প আটকে যায় কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই প্রকল্পের চতুর্থ ও শেষ কিস্তির টাকা আমরা পাব কি না এনিয়েও শঙ্কায় আছি।”

যোগাযোগ করা হলে স্বপন কুমার ঘোষ আরডিপিপিতে সম্মানী নেওয়ার বিধান যুক্ত করার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে স্বীকার করেন।

“এটা আমরাই লিখেছিলাম। কারণ ৫০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট করতে হবে। কমিটির লোকের জন্য এই সম্মানীটা রাখা ছিল।”

ছয় বছরমেয়াদী প্রকল্প শেষ হওয়ার দুই মাস আগে মধ্যবর্তী মূল্যায়ন যৌক্তিক কি না জানতে চাইলে উত্তর না দিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব স্বপন।

আর সম্মানী চাওয়ার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে আরেক কর্মকর্তা ইমরুল বলেন, “মিডটার্ম ইভালুয়েশন অন্য মিটিংয়ের মত মিটিং না, এটা রিপোর্ট বেইজড। .. এই রিপোর্ট প্রণয়ন করতে ৭-১০ দিন সময় লাগবে। সেই কারণে এটার অনারিয়াম হিসেবে রাখা হয়েছিল।”

প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবর্তী মূল্যায়নের ব্যাখ্যায় খানিকটা সময় নিয়ে তিনি বলেন, “দুই মাস আগে আসলে হয় নাই। উনারা মিটিং করতে দেরি করেছেন। আরও দুই/তিন মাস আগেই এই মিটিং করার কথা ছিল।

“উনাদের কাজের যে অবস্থা মিডটার্ম ইভালুয়েশন এখনই বেশি জরুরি। কারণ কাজের খারাপ অবস্থা। জুনে কাজ শেষ করতে পারবেন বলে মনে করি না। উনারা অনেক পিছিয়ে আছেন, আমরা আমাদের রিপোর্টেও তা নিয়ে আসব।”

চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় না দেওয়া ও অন্য প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়ার হুমকির কথা অস্বীকার করে ইমরুল বলেন, “এক প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতির উপর অবশ্যই অন্য প্রকল্পের অবস্থা নির্ভর করবে, সেটা ঠিক।”

প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার ব্যাখ্যা দিয়ে উপাচার্য বলেন, “শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অর্থের স্বল্পতা থাকায় ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সব টাকা পাওয়া যায়নি; মাত্র ৩৩ কোটি টাকা পাওয়া যায়। ফলে কিছু কিছু কম্পোনেন্ট টেন্ডার করতে দেরি হয়ে যায়, প্রকল্প শেষ করা যায়নি। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সব মিলে ৪০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে।”

আইন অনুযায়ী একটি প্রকল্পের মেয়াদ তিন দফা বাড়ানো যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, টাকা না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়কে জানালে তারা এক বছর মেয়াদ বাড়ায়। পরে দ্বিতীয় দফায় পরিকল্পনা কমিশন আরেক বছর মেয়াদ বাড়ায়।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ বিষয়ে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একটি রিপোর্ট দিতে বলেছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ৮০ কোটি ১০ লাখ টাকায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার, যার মেয়াদ ধরা হয় ২০১০-২০১৪ পর্যন্ত।

প্রথমে এই প্রকল্পের বিবিধ খরচ ধরা হয় ৫৫ লাখ টাকা। তবে দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের অর্থ ৬ কোটি ২৬ লাখ বাড়িয়ে ৮৬ কোটি ৩৬ লাখ করা হলে বিবিধ খরচ ১৫ লাখ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ লাখ টাকা।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে একটি চারতলা অ্যাকাডেমিক ভবন, একটি চারতলা ছাত্র হল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল), একটি ছয়তলা ফাউন্ডেশনের ছাত্রী হলের চারতলার একাংশ, আরেকটি ছাত্রী হলের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার সম্প্রসারণ, গেস্ট হাউজ কাম ক্লাবের একাংশ, প্রশাসন ভবনের তিনতলার একাংশ, সেন্ট্রাল সায়েন্স ল্যাবের তিনতলার একাংশ এবং শারীরিক শিক্ষা বিভাগের একটি অংশ নির্মাণ করা হচ্ছে।