ষাটের দশকে উপনিবেশিক শাসকের যাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালির যন্ত্রণা এবং তা থেকে পরিত্রাণে ঘুরে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারকে অঙ্গীভূত করে বাংলা কবিতার জগতে এসে আলোড়ন তৈরি করা এই কবি চলে গেলেন ‘সুতোর ওপারে’। রেখে গেছেন তার কয়েক দশকের কাব্যসাধনা- বিষয় বৈচিত্র্য ও শিল্প প্রকরণে তা বাংলা কবিতাপ্রেমীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন তার সমকালীন লেখকরা।
সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, “তিনি একটা কবিতায় বলেছিলেন, ‘চলে যাব সুতোর ওপারে’। আজ তিনি সুতোর ওপারে চলে গিয়েছেন। তার পেছনে রেখে গেলেন আমাদের অশ্রু আর অশ্রুমাখা তার অমর পঙক্তিগুলো। তার এই কবিতাগুলো আমাদের বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে থাকবে।”
কবিতায় রফিক আজাদের আবির্ভাব অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষায়। ষাটের দশকের শুরুতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মলয় রায় চৌধুরীদের নেতৃত্বে কলকাতায় ‘হাংরি জেনারেশন’ নামে যে সাহিত্য আন্দোলন হয় তারই আদলে ঢাকায় হয় ‘স্যাড জেনারেশন’ কাব্য আন্দোলন। এই আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন রফিক আজাদ।
এই আন্দোলনের ইশতেহারও তারই লেখা: “আমরা গতানুগতিকতাবিরোধী, সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মধ্বংসী, মৃত্যুপরায়ণ, বিষণ্ণ। আমাদের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু সিগারেট, আমাদের রক্তের মধ্যে বিস্ফোরণোন্মুখ ডিনামাইট, (জীবন নিরর্থক জেনে) আমরা নিঃশেষিত, বিব্রত, ক্লান্ত এবং বিষণ্ন।”
এই মানসিকতার ছাপ রফিক আজাদের প্রথম দিকের কবিতার সব জায়গায়।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে- সেই থেকে অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে কবির দৃপ্ত উচ্চারণ পাওয়া যায়।
দখলদার পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন এবং তা থেকে বাঙালির মুক্তি- এই যুগসন্ধিকালে বাঙালির মানসপটকে কবিতায় তুলে এনেছেন তিনি।
তাই ষাট-দশক ও রফিক আজাদ সম্পর্কে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মূল্যায়ন: “ষাটের দশক বলতে যে ক্লেদ এবং কদর্যতার ছবি আমাদের চোখে ভাসে, ষাটের রফিক প্রায় তারই প্রতীক। যে পচন এবং বিকার, রোগ এবং বৈকল্য এই দশককে নিঃশোষিত করেছিল, যে কালো অবক্ষয় আমাদের সামাজিক অঙ্গনের বুকের ওপর কঠিন ও নিথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, রফিক তারই প্রতিভূ।”
দেশের স্বাধীনতার জন্য রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে লড়েছেন কবি রফিক আজাদ। একাত্তরে নিজের এলাকা টাঙ্গাইলে আবদুল কাদের সিদ্দিকী নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এই কবি। তার মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যান কাদের সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে রণাঙ্গনে ছিলেন রফিক আজাদ। বহুজন ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তিনি যাননি, রণাঙ্গনেই ছিলেন। তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। অস্ত্র হাতে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের সাহস জুগিয়েছেন।
“একটা কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার কমান্ডার আমাকে আত্মসমর্পণ করতে শেখায়নি’। তিনি কখনও কোনো কিছুর কাছে আত্মসমর্পণ করেননি।”
স্বাধীনতা উত্তরকালে সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যে কষ্ট পেয়েছেন রফিক আজাদ, হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদী। লিখেছেন ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো’।
“তেমনি আরেকটা দৃশ্য আছে রংপুর স্টেশনে- কেউ বদহজম হইছে, বমি করেছে, সেই বমির উপর একটা ক্ষুধার্ত লোককে- তাকে বলা হয়েছে যে, মুখ লাগানোর চেষ্টা করবি। লাগাতে হবে না, একশ টাকা পাবি।
“এগুলো সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক ছাপ ফেলছে, তাদের মনে প্রচণ্ড ক্রোধ জমে গেছে। আমারও। তো এই ক্রোধ থেকেই ‘ভাত দে হারামজাদা’ লেখা।”
এই কবিতার জন্য দেশদ্রোহের অভিযোগের মুখে পড়েন রফিক আজাদ। এজন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার বিরাগভাজন হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবির ‘স্বাধীনতা’য় হস্তক্ষেপ করেননি বলে বলেছিলেন তিনি।
“বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী আর আনওয়ারুল আলম শহীদ, বঙ্গবন্ধুর কাছে আমারে নিয়া গেছিলেন। উনি ব্যাখ্যা চাইলেন। আমি ব্যাখ্যা দিছি, সারা পৃথিবীর নিরন্ন মানুষের প্রধান চাওয়া হলো ভাত। আমি সারা পৃথিবীর লোকের কথা বলছি। আর আমাদের দেশে, নিরন্ন মানুষ এই ভাষাতেই কথা বলে।
“এটা বলার পর উনি বলেন, ‘তা বটে!’ আমার কাঁধে হাত রাইখা বলল, ‘ভালো লিখছিস, যাহ’।”
“বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারছিলেন যে কবি এইটা লিখতেই পারে। আসলে কি, কেউ কেউ এই কবিতাটার ভুল ব্যাখ্যা করেছিল,” বলেন তিনি।
সমাজের সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধেও লিখেছেন রফিক আজাদ। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ১৯৭৭ সালে তিনি লিখেছেন, “নির্বিবেক মধ্যবিত্ত পাঠকের পরম্পরাময়/মাংসল পাছায় খুব কষে লাথি মারা সম্ভব হয় না বলে/লাথির বিকল্পে লেখা, বারবার, মুদ্রিত পৃষ্ঠার মাধ্যমে পাঠাই।”
এ বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আসলে মধ্যবিত্ত কোনো রিস্ক নিতে চায় না, কোনো দায়িত্ব নেয় না। শুধু দেখে যায়, কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না।”
এরপরেও বাঙালির শক্তির প্রতি আস্থাশীল ছিলেন কবি: “বাঙালির আবেগ আসলে মহৎ আবেগ। এই আবেগ না থাকলে অনেক কিছুই হতো না। হাজার হাজার বছর আগের এই জাতি বিপুলভাবে আবেগে জেগে উঠেছিল বলে একটি দেশ তৈরি করতে পেরেছিল।”
বিশ্ব রাজনীতি নিয়েও সচেতন ছিলেন কবি রফিক আজাদ। সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহনে নোবেল পুরস্কারও জোটে বলে মনে করতেন তিনি।
“সারা পৃথিবীতে যারা অশান্তি ক্রিয়েট করে, তারা শান্তি পুরস্কার পায়। আশ্চর্য! মিসরে এক অশান্তি সৃষ্টিকারী পেয়েছিল। অধিকাংশই অশান্তি সৃষ্টিকারী শান্তি পুরস্কার পেয়েছে।”
কবিতায় প্রতিবাদের সুর ছড়ানো এই কবি ব্যক্তিগত জীবন-যাপনেও ছিলেন অনেকটা বেপরোয়া। লেখক হয়ে ওঠার কালে তার কাছে পাঠ নিয়েছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। স্মৃতিচারণমূলক এক লেখায় রফিক আজাদ বাংলা একাডেমিতে কর্মরত থাকাকালে তাকে প্রথম দেখার বর্ণনায় তিনি বলেছেন, “সাদা রংয়ের হাতাকাটা টাইট গেঞ্জি পরা৷ গলায় মোটা চেন, এক হাতে তামার বালা, অন্য হাতে সিগ্রেট।”
মিলন কিছুদিন বিদেশে কাটানোর পর দেশে ফিরে এলে তাকে পেয়ে রফিক আজাদের বেতনের পুরোটা দিয়ে মদ পানের কথাও উঠে এসেছে তার ওই লেখায়।
নারী ও প্রেমকে কবিতার মুখ্য বিষয় মনে করতেন রফিক আজাদ। নিজেকে প্রেমের কবি বলেছেন তিনি।
ভালোবাসার জন্য তার আকুতির প্রকাশ:
“যদি ভালোবাসা পাই আবার শুধরে নেবো
জীবনের ভুলগুলি;
যদি ভালোবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘ পথে
তুলে নেবো ঝোলাঝুলি।”
প্রেমের ক্ষেত্রে এক রৈখিক ছিলেন না; যৌনতা যেমন তার কবিতায় স্থান পেয়েছে, তেমনি তার ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসার কথা শুনিয়েছেন তিনি।
“লাম্পট্যে সে মুঘল সম্রাট; নির্বিবেক বদমাশ,
ঘৃণ্য গণিকালয়ের সন্ত!- যদিও জানে না কেউ
নবুয়ত-প্রাপ্তিকালে পয়গম্বরের মতো সে শিউরে ওঠে
অন্তরঙ্গ গণিকাবৃন্দের নষ্ট ঊরুর আঘ্রাণে।”(কবি)
আবার এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেছেন, “প্রেমের ক্ষেত্রে শরীর তো অবশ্যই একটা ব্যাপার। কিন্তু শরীরেরও বয়স আছে। সেই বয়স উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর কেন পরস্পরের প্রতি এতটা টান, এতটা ভালোবাসা? তখন শরীর কোনো বিষয় না। এই রসায়ন কোত্থেকে আসে? তাই প্রেম আসলে একটি অনন্ত রসায়ন বেঁচে থাকার জন্য, প্রাণ ধারণের জন্য।”
কবিতার বিষয় যা-ই হোক না কেন তার শৈল্পিক মান রক্ষায় সব সময় সচেতন ছিলেন রফিক আজাদ।
“শব্দকে বিন্যস্ত করে তবেই সংস্কৃতি,
তা- না- হলে শব্দ সে তা মৃত অভিধান,
বনকে বিন্যস্ত করে তবেই উদ্যান
না- হলে-তো বন সে যে শুধুই প্রকৃতি।” (প্রকৃতি ও সংস্কৃতি)
তবে ভাষার ক্ষেত্রে কোনো জায়গায় আটকে থাকায় বিশ্বাসী ছিলেন না রফিক আজাদ। তার মতে, নদী যেমন উপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসে, তেমনি ভাষাও। সাধারণের ভাষাকেই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
“চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনে প্রাণে
নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে।
চুনিয়া বিশ্বাস করেঃ
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা- দ্বেষ ভুলে
পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে।”
(চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)
রফিক আজাদের প্রকাশিত অন্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫); চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া (১৯৭৭); প্রেমের কবিতা (১৯৮১); সশস্ত্র সুন্দর (১৯৮২); একজীবনে (১৯৮২); ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৩); অঙ্গীকারের কবিতা (১৯৮৩); প্রিয় শাড়িগুলি (১৯৮৩); হাতুড়ির নিচে জীবন (১৯৮৪); পরীকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ (১৯৮৫); বিরিশিরি পর্ব (১৯৯৯); মৌলবীর মন ভালো নেই (২০০৭) প্রভৃতি।
ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে রফিক আজাদকে একুশে পদক দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের পর সাহিত্য কর্মের জন্য আরও অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি।