যে অপরাধে ফাঁসিকাষ্ঠে মীর কাসেম

জামায়াতের অর্থ যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হল মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদকে খুনের দায়ে।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2016, 12:19 PM
Updated : 3 Sept 2016, 06:30 PM

এই মীর কাসেমের নির্দেশেই একাত্তরে চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় এক হিন্দু ব্যক্তির ভবন দখল করে ডালিম হোটেল নাম দিয়ে সেখানে বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি ও বন্দিশিবির গড়ে তোলা হয়।

জসিমকে অপহরণের পর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় এই ডালিম হোটেলেই, যাকে ‘মৃত্যুপুরী’ আখ্যা দিয়েছেন বিচারকরা।

২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে জসিমসহ মোট আটজনকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছিল।

রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে তাকে ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দিলেও জসিম হত্যার ঘটনার ১১ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার রায় বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট।

২০১৬ সালের ৮ মার্চে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া ওই রায় পুনর্বিবেচনায় কাসেমের করা রিভিউ আবেদন ৩০ অগাস্ট খারিজ হয়ে গেলে আপিলের রায়ই বহাল থাকে।

জামায়াতের শুরা সদস্য মীর কাসেমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ৪ ও ৬ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল সাত বছর করে সাজার রায় দিলেও তাকে খালাসের রায় দেয় আপিল বিভাগ।

তবে ২, ৩, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগের বিষয়ে সাজার রায়ের বিরুদ্ধে করা আসামির আপিল সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেওয়ায় মীর কাসেমের মোট ৫৮ বছর কারাদণ্ডের সাজা বহাল থাকে।

এছাড়া ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালের রায়েই খালাস পান একাত্তরের এই বদর নেতা। আপিল বিভাগ সেগুলো বিবেচনা করেনি।

যে অভিযোগে ফাঁসি

অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়ে জসিমকে হত্যা করা হয়। এরপর অজ্ঞাত আরও পাঁচটি লাশের সঙ্গে তার মৃতদেহও কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

ট্রাইব্যুনালে তিন বিচারকের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় হয়, যা আপিলেও বহাল থাকে।

কারাদণ্ড যেসব অভিযোগে

অভিযোগ ২: মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯ নভেম্বর দুপুর ২টার দিকে চাক্তাই এলাকার বকশিরহাটে জনৈক সৈয়দের বাড়ি থেকে লুৎফর রহমান ফারুক ও সিরাজকে অপহরণ করে। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দরকিল্লার মহামায়া ভবনের (ডালিম হোটেল) নির্যাতন কেন্দ্রে।

পরে লুৎফর রহমান ফারুককে বাইরে নিয়ে গিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের কর্মীদের বাড়িগুলো চিহ্নিত করিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফারুককে আরও দুই-তিনদিন ডালিম হোটেলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এরপর তাকে সার্কিট হাউজে নিয়ে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়াহয়। সেখানেও তার উপর নির্যাতন চালানোর পর চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরে সেখান থেকে ছাড়া পান ফারুক।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০ বছরের কারাদণ্ড আপিলে বহাল রাখা হয়।

অভিযোগ ৩: মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তান সেনারা ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ডবলমুরিংয়ের কদমতলীর বাসা থেকে অপহরণ করে। তাকে ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে মীর কাসেমের উপস্থিতিতে নির্যাতন চালানো হয়। বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর সকালে ডালিম হোটেল থেকে জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে তার আত্মীয় ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ৭ বছরের কারাদণ্ড আপিলে বহাল থাকে।

অভিযোগ ৭: একাত্তরের ২৭ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের পরে মীর কাসেমের নির্দেশে ডবলমুরিং থানাধীন ১১১ উত্তর নলাপাড়া থেকে মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও ইলিয়াসকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। সেখানে তাদের আটকে রেখে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়।

পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করার শর্তে মীর কাসেমের নির্দেশে ৬ ডিসেম্বর হাবিবুর রহমান এবং ৯ ডিসেম্বর মো. সানাউল্লাহ চৌধুরীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ৭ বছরের দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

অভিযোগ ৯: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ২৯ নভেম্বর ভোরে মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে চান্দগাঁও থানাধীন নাজিরবাড়ি এলাকা থেকে পাঁচ চাচাতো ভাইসহ নুরুজ্জামানকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা। সেখানে তাদের আটকে রেখে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরে তারা সেখান থেকে মুক্ত হন।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীকে দেওয়া ৭ বছরের দণ্ড আপিলেও বহাল রাখা হয়েছে।

অভিযোগ ১০: মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে একাত্তরের ২৯ নভেম্বর ভোর ৫টার দিকে আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা নাজিরবাড়ি এলাকা ঘেরাও করে মো. জাকারিয়া, মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়া, ইস্কান্দর আলম চৌধুরী, মো. নাজিম উদ্দিনসহ আরও অনেককে অপহরণ করে এনএমসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে যায়। পরে তাদের সবাইকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। বয়সে ছোট হওয়ায় নাজিমুদ্দিনকে পরদিন ছেড়ে দেওয়া হয়। সাত-আটদিন পর মো. জাকারিয়াকে, ১১ অথবা ১২ ডিসেম্বর মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ছাড়া পান ইস্কান্দর আলম চৌধুরী।

এ ঘটনায় মীর কাসেমকে দেওয়া ৭ বছরের কারাদণ্ড আপিল বিভাগে বহাল থাকে।

অভিযোগ ১৪: নভেম্বর মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন নাজির আহমেদ চৌধুরী রোডে এ জে এম নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। একদিন গভীর রাতে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে কয়েকজন আলবদর সদস্য ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে। সেখান থেকে নাসিরুদ্দীন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। ১৬ ডিসেম্বর ডালিম হোটেল থেকে আরও এক-দেড়শ লোকের সঙ্গে নাসিরুদ্দিন চৌধুরীকেও উদ্ধার করে স্থানীয়রা।

এ ঘটনায় মীর কাসেমকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল থাকে।

মীর কাসেম আলী

 
টেকেনি সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রথম রায়

অভিযোগ ১২: ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের কোনো একদিন মীর কাসেম আলীর পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা হিন্দু অধ্যুষিত হাজারি লেনের ১৩৯ নম্বর বাড়ি থেকে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং ১১৪ নম্বর বাড়ি থেকে রঞ্জিত দাস ওরফে লাঠুকে ও টুনটু সেন ওরফে রাজুকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। পরদিন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ছেড়ে দেওয়া হলেও লাঠু ও রাজুকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়। এই তিনজনকে অপহরণের সময় আলবদর বাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনেক দোকানপাট লুট করে এবং অন্তত আড়াইশ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এর ফলে অন্তত ১০০ হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়।

এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুই বিচারক একাত্তরে দুইজনকে হত্যার ঘটনায় কাসেমকে দোষী সাব্যস্ত করলেও একজন বিচারক আসামির খালাসের পক্ষে মত দেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায় আসে। আপিল বিভাগ চূড়ান্ত বিচারে এ অভিযোগ থেকে মীর কাসেমকে খালাস দেয়।  

আপিলে আরও দুই অভিযোগে খালাস

অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর গভীর রাতে মীর কাসেম আলীর উপস্থিতিতে ডবলমুরিং থানাধীন আজিজ কলোনি থেকে সাইফুদ্দিন খানকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। সেখানে অন্যদের সঙ্গে তাকেও মারধর করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর জেল থেকে ছাড়া পান সাইফুদ্দিন।

অভিযোগ ৬: মীর কাসেমের নির্দেশে ২৮ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় আলবদর সদস্যরা হারুন-অর-রশিদকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে চোখ ও হাত বেঁধে তাকে নির্যাতন করা হয়। পরে মীর কাসেমের নির্দেশে তাকে চোখ-হাত বাঁধা অবস্থাতেই পাঁচলাইশের সালমা মঞ্জিলে আরেকটি নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর সেখান থেকেই তাকে উদ্ধার করা হয়।

এ দুটি ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেমকে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছরের কারাদণ্ড দিলেও আপিলে তিনি খালাস পান।

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে কাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।

ঠিক তিন বছরের মাথায় সব বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর শনিবার রাতে এই যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর করা হয়।