জরুরি অবস্থার সময় ডিজিএফআইয়ের ‘সরবরাহ করা’ খবর যাচাই ছাড়া প্রকাশের ‘ভুল’ ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম স্বীকারের পর তা নিয়ে আলোচনার মধ্যে সোমবার সংসদে একথা বলেন তিনি।
সম্প্রতি এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ‘ভুল’ স্বীকারের পর মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মামলার পাশাপাশি চলতি সংসদের নবম অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের বক্তৃতায় তার বিচারের দাবি ওঠে।
সম্প্রতি দলীয় এক আলোচনা সভায় জরুরি অবস্থার সময় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ভূমিকার সমালোচনা করার পর সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায়ও সেই প্রসঙ্গটি তোলেন সংসদ নেতা হাসিনা।
তিনি বলেন, “ওই পত্রিকার উপরে লেখা থাকে নির্ভীক সাংবাদিকতা। ইংরেজি-বাংলা অর্থ্যাৎ ডেইলি স্টার-প্রথম আলো। নামগুলো সুন্দর। ডেইলি স্টার একেবারে আকাশের তারা, দিনের বেলায়ও দেখা যায়। আরেকটির নাম হল প্রথম আলো। মানে আলো ফুটে যায়। আর তাদের কাজ হল অন্ধকারের কাজ। তাহলো ডিজিএফআইর লেখা ছাপানো।
“এই লেখা নাকি ডিজিএফআই তাকে সাপ্লাই দিয়েছে। আমার প্রশ্ন, এখানে এই লেখাগুলো যে ছাপানো, সেখানে তো সূত্র উল্লেখ নেই। আমি তো সরকারে ছিলাম না, বিরোধী দলের নেতা ছিলাম। তাহলে আঘাত আমার পরে আগে কেন? গ্রেপ্তার কেন আমাকে আগে করা হল?”
“আমার বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা। বিএনপির আমলে এক ডজন মিথ্যা মামলা দিয়ে রেখেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার ৫/৬টা মিথ্যা মামলা। মামলা দেওয়া ও গ্রেপ্তারের আগে ওই পত্রিকা আমাকে দুর্নীতিবাজ বানানোর জন্য মিথ্যা কথা লিখে গেছে। অসত্য তথ্য দিয়ে গেছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “২০টা বছর অনবরত আমার বিরুদ্ধে লিখে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে আমি কারাগার থেকে বের হওয়ার পর থেকে এই দুটি পত্রিকা পড়ি না। আর সরকার প্রধান হওয়ার পর তো মোটেও পড়ি না।”
সেনা নিয়ন্ত্রিত ওই সরকারের সময় বন্দি করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। এরপর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও।
তখন দুই প্রধান নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করার একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং তাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করে আসছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
শেখ হাসিনা বলেন, “ডিজিএফআইয়ের দুই অফিসার একজন ব্রিগেডিয়ার আমিন আরেক জন ব্রিগেডিয়ার বারী। তাদের অত্যাচারে এদেশের শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে কেউই রেহাই পায়নি। প্রত্যেকের উপর এরা অত্যাচার করেছে। যখন যাকে খুশি ধর, জেলে পুরো।
“যারা এভাবে অত্যাচার করেছে, তাদের সাথে কী এমন সখ্যতা ওই এডিটরের ছিল আমি সেটাই প্রশ্ন করি। মাহফুজ আনাম সম্পাদক তার কাছে আমার প্রশ্ন- সে কী তার উত্তর দিতে পারবে? বা প্রথম আলোর মতিউর রহমান কী তার উত্তর দিতে পারবে যে এত সখ্যতা কেন?”
“একটা প্রশ্ন জাগে... নির্ভীক সাংবাদিকতা, না ডিজিএফআইয়ের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে তারা। তাদের এজেন্ট হিসেবে তারা এসমস্ত তথ্য দিয়েছে। অথবা তাদের পে-রোলে ছিল। তাদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে করেছে। অথবা তাদের দূতিয়ালি করেছে। অথবা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। অবশ্যই ষড়যন্ত্রেই তো লিপ্ত ছিল। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না থাকলে এ ধরনের মিথ্য অসত্য তথ্য তারা ছাপাবে কেন? যাদের দ্বারা সবাই অত্যাচারিত, তাদের দ্বারা এই দুজন লালিত-পালিত।”
দুই সম্পাদকের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক অভিলাষ কারও থাকলে ভোটে আসতে হবে।
“এদের চেষ্টাই হল, সব সময় বাংলাদেশে যেন একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তারা চায়, অসাংবিধানিকভাবে কেউ ক্ষমতায় আসুক। অসাংবিধানিকভাবে যেন এদেশ চলে। তাহলে তাদের গুরুত্ব বাড়ে। রাজনীতি করবার যদি ইচ্ছা থাকে, ক্ষমতায় যাওয়ার যদি ইচ্ছা থাকে, তাহলে দল গঠন করে রাস্তায় নামুন।”
“মানুষের ভোটে বিশ্বাস নাই, জনগণের উপর বিশ্বাস নাই। ওই ডিজিএফআইর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখে! আর এই স্বপ্নের সাথে আবার আরেক জন জড়িত। যিনি দল করার চেষ্টা করেন। ঘোষণা দিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ডাবল এ প্লাস দেওয়া হবে। আর তার দেওয়া তালিকা নিয়ে এই দুই সম্পাদক নেমে পড়ল দলের লোকে গোছাতে। কিন্তু কেউ আসে না, সাড়া দেয় না। সেই দল আর কেউ করতে পারল না। একটা দল করার যোগ্যতা নেই!”
জরুরি অবস্থার সময় রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়ে বিফল হওয়া নোবেলজয়ী ইউনূসকে বয়স পেরিয়ে যাওয়ার কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ। এর বিরুদ্ধে তিনি আদালতে গিয়ে আইনি লড়াইয়ে হেরে যান।
এরপর ইউনূস পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন ঠেকাতে তৎপরতা চালিয়েছিলেন বলে আগেও ইঙ্গিত করেছিলেন শেখ হাসিনা।
“তবে এদের ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। এরা এখনও ভাবে, কোনোমতে যদি একটু গণতন্ত্রকে ধরাশায়ী করা যায়, আর অগণতান্ত্রিক পন্থায় কিছু আসে, তাদের কপালটা খুলবে,” সংসদে বলেন তিনি।
সেই সঙ্গে তিনি বলেন,“বাংলাদেশের মানুষ এখন সচেতন। যে যত ষড়যন্ত্র করুক আমাদের অগ্রযাত্রা কেউ রোধ করতে পারবে না। এ বিশ্বাস আমাদের আছে।”
মাহফুজ আনামকে নিয়ে ঘটনায় বিদেশিদের উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী টেলিভিশন আলোচনা অনুষ্ঠানে সরকারের সমালোচনার নজির তুলে ধরে বলেন, গণমাধ্যমের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে না।
“স্বাধীনতাই যদি না থাকল তাহলে এত কথা বলল কী করে? এত কথা এল কীভাবে? কাউকে তো বাধা দেওয়া হচ্ছে না। ইচ্ছামতো মনের মাধুরী মিশিয়ে যেভাবেই হোক কথা বলেই যাচ্ছেন, আলোচনা করেই যাচ্ছেন।”
“মিডিয়ার জন্য যত বেশি সুযোগ আমি করে দিয়েছি, এত বেশি আর কখনও কেউ দেয়নি। কিন্তু আমিই সব থেকে ভিকটিম,” বলেন শেখ হাসিনা।