রেসিডেন্সিয়ালের শিক্ষার্থীদের ‘ঘরে ফেরা’

জীবনের বেড়ে ওঠার বড় একটি সময় কেটেছে এক ক্যাম্পাসে, এক ভবনে, কারও ক্ষেত্রে একই কক্ষে, সুখ-দুঃখের কত স্মৃতি; অথচ দেখা নেই কর্মব্যস্ত জীবনে। পুরনো দিনের বন্ধুকে পেয়ে যেন ফিরে এলো সেই উদ্দাম জীবন-তারুণ্যের সময়।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2016, 06:01 PM
Updated : 13 Feb 2016, 02:55 PM

শুক্রবার ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনীতে দিনব্যাপী আড্ডা, সেলফি-ছবি তোলা, ছাত্রজীবনের মতো খেলার মাঠে নামা, চেনা ক্যাম্পাসের অলিগলি ঘুরে দেখায় সময় কাটান কয়েক হাজার মানুষ।

স্ত্রী-সন্তানকেও নিয়ে আসতে দেখা যায় অনেককে। বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় ও ক্যাম্পাসজুড়ে ঘোরাঘুরির মধ্য দিয়ে কাটে তাদের সময়।

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আবাসিক এই বিদ্যাপীঠে ফেরাকে বহুদিন পর নিজের ঘরে ফেরা বলে মন্তব্য করেন সাবেকরা।

দিনব্যাপী এই আনন্দযজ্ঞের শুরু হয় শুক্রবার সকালের নাস্তার মধ্য দিয়ে; রাতে জনপ্রিয় ব্যান্ড দলের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে ভাঙে এই মিলনমেলা।

দীর্ঘদিন পর পুরনো বন্ধুদের কাছে পাওয়ার উচ্ছ্বাস।

বহু দিন পর বন্ধুকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে নেওয়া।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে এইচএসসি ১৯৯৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী তৌহিদ ওসমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই স্কুল-কলেজ আসলে আমাদের বাড়ির মতো। আমি এখানে ছয় বছর ছিলাম। কয়েক মাস পর পর আমরা এখানে আসি। এমন অনেক শিক্ষার্থীকে খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা এই প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে যত সময় ছিলেন, অন্য ঠিকানায় এত সময় ছিলেন না।”

২০০৫ সালে এইচএসসি পাস করে যাওয়া শিক্ষার্থী মিলন সিদ্দিকী ক্যাম্পাসে আসলেন ১০ বছর পর। এই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের এবার একত্রিত করার উদ্যোগটাও তারই।

সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধ্যায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিজেকে আবার আবিষ্কার করে গেলাম, যেন অস্তিত্ব ফিরে পাওয়ার জন্যই এখানে এসেছিলাম।

“নানা ধরনের ব্যস্ততার কারণে এতদিন আসা হয়নি। তবে এখন মনে হচ্ছে, মাঝে মাঝেই আসা উচিত।”

মিলনের ডাকে সাড়া দিয়ে আসেন একই ব্যাচের শিক্ষার্থী সাংবাদিক শাকিল হাসান। কলেজ জীবনে নজরুল ইসলাম হাউজে থাকতেন তিনি।

পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

“বন্ধু সোহাগ খান সেখানে দুই বছর আমার রুমমেট ছিল। তার সঙ্গে এত বছর পর আজ দেখা। আজ আবার আমরা সেই রুমে গিয়েছি, দিনভর সেই বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়েছি। এই অনুভূতি বোঝানো যাবে না,” বলেন শাকিল।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, “১৯৬৮ সাল থেকে এই স্কুলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। আমি অন্য কোনো স্কুল-কলেজে পড়ি নাই। আমার বাড়ি-ঘর সব কিছু এই স্কুল।”

১৯৭৯ সালে এই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন জোবায়দুর।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এই স্কুল থেকে এইচএসসি পাস করেন ১৯৮২ সালে। কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ওল্ড রেমিয়ান্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নতুন সভাপতি হয়েছেন তিনি।

পুনর্মিলনীতে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “কেবল শিক্ষা দিয়ে সামনে যাওয়া যায় না, নেতৃত্ব দিতে জানতে হয়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছে।”

কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে নসরুল হামিদ বলেন, “ছাত্র জীবনে সেরা শিক্ষার্থী হলেই হবে না, সেরা নাগরিকও হতে হবে।

“বাংলাদেশের সেরা নাগরিক তৈরির কাজ করছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনপথ পাড়ি দিতে নেতৃত্ব শেখায়।”

পুনর্মিলনীতে সাবেক শিক্ষার্থীদের সেলফি।

উচ্ছ্বাসে কমতি ছিল না বর্তমানদের।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। এটি তৈরি করা হয়েছিল ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ‘পাবলিক স্কুলগুলোর’ আদলে। পুরোপুরি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে হয়েছিল এর সূচনা।

প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন নেতা তৈরি করতেই প্রতিষ্ঠার সময় এ স্কুলে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছিল, যা ছিল সেই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। ষাট থেকে আশির দশকে এ স্কুলে পড়ে যাওয়া অনেকেই এখন রাজনীতি থেকে শুরু করে খেলাধুলা- সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘উজ্জ্বল নক্ষত্র’ হিসেবে পরিচিত।

ওল্ড রেমিয়ান্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান।

এসএসসি ১৯৭৭ ব্যাচের এই শিক্ষার্থী ছিলেন অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক, নানা কাজের মাঝেই বন্ধুদের আড্ডায় সময় দেন তিনি। সন্ধ্যায় মাঠে চেয়ার পেতে বসা কয়েকজন বন্ধুর মাঝে পাওয়া যায় তাকে।

পুনর্মিলনীতে এসে বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফ্রেমবন্দি হতে দাঁড়িয়ে যান সাবেকরা।

বহু দিন পর ক্যাম্পাসে ফিরে খেলার মাঠে নেমে যান সাবেক শিক্ষার্থীরা।

আড্ডার ফাঁকে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবারের আয়োজনটা নানা দিক থেকেই ব্যতিক্রম। অন্যবার দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মানুষের সমাগম হলেও এবার প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে।

পঞ্চম শ্রেণি থেকে এই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে আসা মশিউর বলেন, “এই স্কুল আমাদের অন্যতম ঠিকানাও।”

তার ব্যাচের শিক্ষার্থী প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন জোয়ার্দার জানান, কুষ্টিয়ায় স্কুল পেরিয়ে এসে ঢাকার এই কলেজে পড়েন, পরে যান বুয়েটে।

“আমার এখানকার বন্ধুদের সঙ্গেই যোগাযোগ বেশি। এটাই আমার মূল সার্কেল। আমার জীবনের বড় অর্জন আমি এই কলেজে পড়েছি।”

প্রতিবছর পুনর্মিলনীতে আসা গিয়াস উদ্দিন বলেন, “হয়তো আমাদের অনেক বয়স হয়েছে, বিয়ে করেছি, সন্তান হয়েছে। কিন্তু এখানে আসলে আমরা সেই কৈশোরের দিনগুলোতেই ফিরে যাই।”

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এই ‘সুপারিনটেনডিং ইঞ্জিনিয়ার’ বলেন, “মনে করেন, বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি, আড্ডা, কোন বন্ধুকে একটা ঘুষি দিলাম, একটা খোঁচা দিলাম-এ সব এখানে না আসলে সম্ভব না। শৈশবে যেমন জীবনে কোনো তাড়া ছিল না, কোনো টেনশন কাজ করত না, এখানে থাকলে সেইভাবে চিন্তামুক্ত সময় কাটাতে পারি।”

উৎসবে শরিক হয়েছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যরা।

বাবার স্কুলে এসে ভালই সময় কাটিয়েছে শিশুরা।

খোলা মাঠের একপাশে প্যান্ডেল সাজিয়ে সন্ধ্যায় হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তারই ফাঁকে হয় সংক্ষিপ্ত আলোচনা, মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে অনুভূতি প্রকাশ করেন অনেক সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। 

এদেরই একজন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীর বিক্রম বলেন, “১৯৬০ সালের ৮ মে যখন এই স্কুলের ফিতা কাটা হয় তখন আমি সেখানে ছিলাম। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হাবিবুর রহমান সেখানে ছিলেন।”

এই প্রতিষ্ঠান শুধু ভালো লেখাপড়াই নয়, জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও ‘মডেল’ হওয়ার শিক্ষা দেয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা আজকে যাওয়ার আগে যথাসম্ভব আমাদের ক্যাম্পাস পরিষ্কার করে যাব। আমরা আজও মডেল থাকব। সর্বক্ষেত্রে।”

সাবেক শিক্ষার্থীদের কাছে পেয়ে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এই কলেজের শিক্ষক ফেরদৌস আরা।

“এটা কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, কেবল শিক্ষাই আদান প্রদানের কাজই আমরা এখানে করি নাই। তোমরা আমাকে মায়ের মর্যাদা দিয়েছ। আমার আজ কাঁদতে ইচ্ছা করছে।”