সাগর-রুনি খুন: ৪৮ ঘণ্টার আশ্বাস, ৪৮ মাসেও হয়নি

সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি ২০১২ সালে খুন হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের ধরার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবকামাল হোসেন তালুকদার ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2016, 03:08 PM
Updated : 10 Feb 2016, 05:53 PM

তার নয় মাস পর কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন ঘটা করে।

এরপর ৪৮ মাস গড়িয়ে গেলেও এখনও এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ র‌্যাব আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিমাসে শুধু তদন্তের ‘অগ্রগতির’ প্রতিবেদনই দিয়ে যাচ্ছে, তবে সেই ‘অগ্রগতি’ কোনো উপসংহারে আসছে না।  

হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে শুরুতে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো রাজপথে থাকলেও নিজেদের বিভাজনের নানা মেরুকরণে সেই সক্রিয়তাও এখন আর নেই।

এই অবস্থায় মামলার বাদী রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান এই হত্যারহস্যের জট খোলার কোনো আশা আর করতে পারছেন না; যদিও র‌্যাব বলছে, সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের একটি পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।

ওই বাসায় বাবা-মায়ের লাশের সঙ্গে শুধু তাদের শিশু সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘকেই পাওয়া গিয়েছিল। অপেশাদার খুনিরা ধারাল অস্ত্রের আঘাতে দুজনকে হত্যা করেছিল বলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়।

বিচার দাবির কর্মসূচিতে দেখা গিয়েছিল ছোট্ট মেঘকেও

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনাস্থলে গিয়ে সবার সামনে বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার  মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে; যা না ঘটার পর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে।

চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের পর রুনির ভাই নওশের শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন। থানার হাত ঘুরে তদন্তের দায়িত্ব যায় ডিবিতে।

৬২ দিন পর ডিবির আদালতের কাছে ব্যর্থতা স্বীকার করলে তদন্তের দায়িত্বে আসে র‌্যাব। এখনও তারাই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

এই হত্যাকাণ্ডের চার বছর পেরুনোর একদিন আগে বুধবার তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে র‌্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব হত্যাকাণ্ডেরই যে দ্রুত রহস্য উদ্ঘাটন হয়ে যায়, তা নয়। স্পর্শকাতর মামলাগুলোতে সময় লাগে।

“সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড একটি স্পর্শকাতর মামলা। এ কারণে এর রহস্য উদ্ঘাটনে একটু সময় লাগছে। র‌্যাব আন্তরিকভাবেই কাজ করছে।”

তিনি জানান, আদালতের নির্দেশে প্রায় প্রতি মাসেই একবার করে তদন্তের ‘অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দিয়ে যাচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তা। সর্বশেষ ১৮ জানুয়ারি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। মামলার পরবর্তী তারিখ রয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি।

ডিবির দুজনের হাত ঘুরে র‌্যাবের দুজন এই তদন্তের দায়িত্ব পালন করেন। ওই চারজনের পর এখন র‌্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহমেদ চালাচ্ছেন তদন্ত।

এই ঘরেই খুন হন তারা

তদন্তে কোনো অগ্রগতি না দেখে হতাশ মামলার বাদী নওশের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই হত্যারহস্যের উন্মোচন হবে বলে আমি এখন আর বিশ্বাস করি না। এভাবেই বছরের পর বছর পার হবে।”

এখনও দৃশ্যমাণ কোনো অগ্রগতি দেখাতে না পারলেও ‘গুরুত্ব’ দিয়েই তদন্ত চলছে বলে দাবি মুফতি মাহমুদের।

“সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চলছে।”

ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। তার প্রতিবেদন আসার পর যাচাই-বাছাই চলছে বলে জানান র‌্যাব মুখপাত্র।

এই আলামতের তালিকায় ছিল হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি ছুরি, ছুরির বাট, সাগরের মোজা, একটি কম্বল, সাগরের পরনের প্যান্ট, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট।

প্রথম দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এসব আলামতে পাওয়া নমুনার সঙ্গে দুজন ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইল মিলেছে বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর কিছু বলা হয়নি এ বিষয়ে। 

নিহত সাংবাদিক দম্পতির পারিবারিক বন্ধু তানভীর, ভবনের দুই নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও এনামুল ওরফে হুমায়ূন কবীর এবং পাঁচ ডাকাত রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ নামে আটজনকে শনাক্তের দাবি করে ২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন সাহারার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে আসা মহীউদ্দীন আলমগীর। 

তখন সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছিলেন মন্ত্রী। পরে পাহারাদার এনামুলও গ্রেপ্তার হন।

র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ জানান, এদের মধ্যে গত বছর তানভির, পশাল রুদ্র পাল ও মিন্টু উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছেন কারাগার থেকে। বাকি পাঁচজন এখনও কারাগারে।

বেশ কিছুদিন বিরতির পর হত্যাকাণ্ডের চতুর্থ বছর পূর্তিতে বিচার দাবিতে বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবে সমাবেশ ডেকেছে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো।

বৃহস্পতিবার কোনো কর্মসূচি রয়েছে কি না- জানতে চাইলে হতাশার সুরে নওশের বলেন, “না, কোনো কর্মসূচি নেই। তবে শুক্রবার বাদ আছর ইন্দিরা রোডে আমাদের বাসায় মিলাদ হবে।”

সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘ এখন গুলশানের একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

এখনও সে মাঝে-মধ্যে বাবা-মার জন্য কান্না করে বলে জানান মামা নওশের।