প্রাণের মেলায় তারুণ্যের উচ্ছ্বাস

লেখক-পাঠকের সেতুবন্ধ তৈরির আয়োজন অমর একুশে বইমেলা নতুন লেখকদের জন্য ভিন্ন মাত্রা যোগ করে প্রতিবছর। কেউ হাসেন বইয়ের কাটতি দেখে, কেউ নজর কাড়েন লেখনীর ধারে।  

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Feb 2016, 03:50 PM
Updated : 9 Feb 2016, 07:33 PM

তবে মঙ্গলবার কয়েকজন তরুণ লেখক জানালেন, তাদের বই প্রকাশের উচ্ছ্বাসের পেছনের অনেক গল্প অনুচ্চারিতই থেকে যায়; পাঠকরাও জানেন না কী বিসর্জন দিতে হয় একটি বইয়ের জন্য।

১৯৭২ সালে স্বল্প পরিসরে এই বইমেলা শুরু হলেও বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে এই মেলা শুরু করে তারও এক যুগ পরে, ১৯৮৪ সালে।

তরুণ লেখক আলীম হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “আমরা তরুণ লেখকরা বই মেলার দিকেই তাকিয়ে থাকি। বই প্রকাশের জন্য যেমন, প্রসারের জন্যও ঠিক তেমনি। মেলা ছাড়াতো নিজেদের তুলে ধরার কোনো সুযোগ নেই। তাই আমিও অন্যদের মতো চাতকের ন্যায়ই তাকিয়ে থাকি।”

বুধবার মেলায় আসছে তার লেখা উপন্যাস ‘রক ক্যাডেট’- এর পরিমার্জিত সংস্করণ এবং কবিতার বই ‘ব্যক্তিত্ববাদ’।

তিনি বলেন, “অনেকে বইমেলায় জোর করে বই বিক্রি করতে যান, এটার আমি বিরোধী। তবে নিজের বইয়ের বিষয়ে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে জানান দেওয়া যেতে পারে।”

মঙ্গলবার বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে মোড়ক উন্মোচন করা হয় তরুণ লেখক ইন্দ্রজিৎ সরকারের দুটি কিশোর উপন্যাস ‘বল্টুর ভয়ংকর অভিযান’ ও ‘মানুষ খেকোর জঙ্গলে গোয়েন্দা সপ্তক’।

তার পঞ্চম বই ‘বল্টুর ভয়ঙ্কর অভিযান’ প্রকাশ করেছে পার্ল পাবলিকেশন্স; অন্যদিকে ষষ্ঠ বই ‘মানুষখেকোর জঙ্গলে গোয়েন্দা সপ্তক’- ছেপেছে দেশ প্রকাশনী।

ইন্দ্রজিৎ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকমকে বলেন, “পরিচিত লেখক, প্রকাশকদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই মেলার সময়টা পার হয়। তবে অন্য দর্শনার্থীদের মতো মেলাকে উপভোগ করার ব্যাপারও থাকে।”

তিনি বলেন, “সাধারণত নবীন লেখকদের বই ছাপতে প্রকাশকরা আগ্রহী হন না। আর নামিদামী প্রকাশনীতো একদমই না। অনেক সময় আগে প্রকাশনীকে টাকা দিয়ে বই ছাপানোর পর বিক্রির পর টাকা ফেরত পাওয়ার ঘটনাও ঘটে।”

বইমেলার লিটল ম্যাগ কর্নারের ‘দাঁড়কাক’ থেকে নিজের প্রথম গল্পের বই ‘ইসরাফিলের প্রস্থান’ এনেছেন খালিদ মারুফ। 

এতে ‘জননী ও পুত্রেরা’, ‘ঘর্মাক্ত সন্ধ্যায় তুমি’, ‘ইসরাফিলের প্রস্থান’, ‘তিব্বত ৫৭০’ এবং ‘সিঁড়ির ধাঁধায় জামালুদ্দিন’ শিরোনামে পাঁচটি গল্প রয়েছে তার।

খালিদ মারুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বইমেলা তো এখন জাতীয় অনুষ্ঠান। লেখক, প্রকাশক, পাঠক ও সংবাদকর্মী সবার একত্রিত হওয়ার একটা বড় সুযোগ এটা।”

“এটা বইয়ের উৎসব। বই নিয়ে আনন্দ উদযাপনের বাড়তি সুযোগ এটা। আমিও মেলার সময়টা আমার বইকেন্দ্রিক থাকি।”

এবারের মেলায় নিজের ষষ্ঠ বই প্রকাশ করেছেন মাজহার সরকার। ‘প্রেরিত পুরুষ’ নামে কবিতার বইটি প্রকাশ করেছে ‘প্ল্যাটফর্ম’।

মাজহার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বইমেলায় শুধু একজন লেখক হিসাবে নয়, পাঠক হিসাবেও যাওয়া হয়। লেখক হিসাবে বাড়তি আনন্দ নিয়ে যাই। এটা এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি করে। আমাদের মুক্তবুদ্ধি চর্চার ভিত্তেই তো এই ফেব্রুয়ারি মাস।”

তিনি বলেন, “আসলে লেখালেখিতে সিনিয়র-জুনিয়র বলে কোনো কথা নাই। আর বই এবং মেলা সংশ্রিমণ এখানে ঘটছে। তাই এখানে বই কিনতে হবে এমন কথা নাই। ঘোরাঘুরি, আড্ডা ও সবার মিলিত হওয়ার জায়গা এটি।”

গল্প, কবিতা ও সম্পাদনা মিলিয়ে মোট পাঁচটি বই নিয়ে এবার পাঠকের সামনে এসেছেন পিয়াস মজিদ। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগে কাজের পাশাপাশি লেখালেখিও করেন তিনি।

পিয়াস মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাঠকের কাছে পৌঁছার সবচেয়ে বড় সুযোগ তো বইমেলা। নতুন ও তরুণ লেখকরা তাই মেলার দিকেই তাকিয়ে থাকে।

“নিজের প্রকাশনার খোঁজখবর করা, অন্য লেখকের সঙ্গে সময় কাটানো এবং ঘোরাঘুরিতে সময় পার করতে হয়।”

অনলাইনের মাধ্যমে নবীন ও তরুণ লেখকরা আগের থেকে বেশি সুবিধা করতে পারছে বলেই তার অভিমত।

“অনলাইনে তারা নিজেদের আলাদা পাঠক সম্প্রদায় তৈরি করতে পারছেন। নিজের বইয়ের প্রচার চালাতে পারছেন। সেটা হয়তো আগে সেভাবে পারতেন না।”

এবারের বইমেলায় তার নতুন আসা বইয়ের মধ্যে রয়েছে অন্যপ্রকাশ থেকে ‘নগর ঢাকায় জনৈক জীবনানন্দ’ (গল্প), ঐতিহ্য থেকে ‘এলোমেলা ভাবনাবৃন্দ’ (প্রবন্ধ), সময় প্রকাশন থেকে ‘কবিকে নিয়ে কবিতা’, অনিন্দ্য থেকে ‘অগ্রন্থিত আবদুল মান্নান সৈয়দ’ (সম্পাদিত) এবং পাঠক সমাবেশ থেকে ‘সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ্বরী (সম্পাদনা)।

বইপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলার ক্ষেত্রে পিয়াস মজিদ বলেন, “এখনকার যারা প্রবীণ লেখক তারাও তো শুরুর দিকে এমনই ছিলেন।”

বইমেলায় অন্যপ্রকাশ থেকে ‘ঢেউয়ের ভিতর দাবানল’ নামে কবিতার বই এনেছেন নওশাদ জামিল। সাংবাদিকতার পাশাপাশি কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লেখেন তিনি।

নওশাদ বলেন, “নবীন লেখকদের জন্য বইমেলা বড় রকমের আনন্দ নিয়ে হাজির হবে- এটাই স্বাভাবিক। আমিও লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের সঙ্গে সেই আনন্দ ভাগাভাগি করি।”

নিজের বই প্রকাশে কোনো প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “নবীন ও তরুণ লেখকের বই ছাপাতে প্রকাশকরা একদমই ছাপাতে চান না। তাদের বইয়ের প্রচার কম। আর প্রচার কম বলে বিক্রিও কম হওয়ার শঙ্কা থাকে।”

“তবে নবীনদের মধ্যেও এখন অনেক অমিত সম্ভাবনাময়ী লেখক রয়েছেন।”

বইমেলার এই নবীন ও তরুণ লেখকদের উচ্ছাসে বাদ পড়েনি ক্ষুদে গল্পকার অলিন বাসারও। এবার বইমেলায় সাঁকোবাড়ি প্রকাশন থেকে ‘ভুতুড়ে’ নামে দ্বিতীয় গল্পের বই এনেছে সে।

অলিন বাসার বলেন, “আমি পড়াশোনা করি, গল্প-কবিতা লিখি। আগের বইমেলায় একটি বই বের করেছিলাম, এবার আরেকটি। বইমেলা আমার আনন্দের জায়গা।”

বইমেলার অন্বেষা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে কবি নাদিম হোসেনের প্রথম কবিতার বই ‘নিদ্রিতা’। এছাড়া আরও দু’টি নবীন লেখকের বই আনবে সংস্থাটি।

অন্বেষার কর্ণধার শাহাদাত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা জন্মলগ্ন থেকে প্রতিবার তিন জন নবীন লেখককে বই প্রকাশের সুযোগ দিয়ে থাকি। যদিও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই, তবুও আমি চেষ্টা করি সেটা করতে।”

“পুরনো লেখকদের নামের কারনে নবীনরা মার খেয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নবীনদের লেখার মাপকাঠি নির্ধারণের সুযোগ থাকলে ভাল হতো, যদিও সেটা কষ্ট ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার।”