বিচারপতি শামসুদ্দিন কথা না বলে ফাইল ফেরত দেবেন: প্রত্যাশা প্রধান বিচারপতির

গণমাধ্যমে কথা না বলে অনিষ্পন্ন সব রায়ের ফাইল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ফেরত দেবেন, সেই প্রত্যাশা করেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2016, 11:17 AM
Updated : 7 Feb 2016, 11:17 AM

অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী রোববার সাংবাদিকদের কাছে নিজের বক্তব্য দেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রধান বিচারপতির এই প্রত্যাশার কথা জানানো হয়।

এতে বলা হয়, “প্রধান বিচারপতি আশা করেন যে সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মিডিয়াতে মামলার রায় ও আদেশ সংক্রান্ত কোনোরূপ বক্তব্য না দিয়ে তার নিকট যতগুলো অনিষ্পত্তিকৃত রায়ের মামলার ফাইল রয়েছে, তা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিসে অতি সত্বর ফেরত প্রদান করবেন, যাতে বিচারপ্রার্থীদের আর ভোগান্তি না হয়।”

বিচারকাজ চলাকালীন সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ‘প্রেস কনফারেন্স’ প্রধান বিচারপতির ‘গোচরীভূত’ হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আসে।

এতে বলা হয়, “সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এ ধরনের প্রেস কনফারেন্স নজিরবিহীন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি আশা করেন, বর্তমান ও ভবিষ্যতে মাননীয় বিচারপতিরা কোর্টের পবিত্রতা ও মর্যাদা বজায় রাখার স্বার্থে এ রূপ কার্য থেকে বিরত থাকবেন।”

অবসরের পর বিচারকদের রায় লেখা ‘সংবিধানবিরোধী’ বলে সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির বক্তব্য আসার পর তা নিয়ে আলোচনা চলছে, যা রাজনৈতিক মহলেও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

চার মাস আগে আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যাওয়া বিচারক শামসুদ্দিন চৌধুরী রোববার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি অবসরে যাওয়ার পর তার লেখা রায় ও আদেশ গ্রহণ করতে প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি।

অবসরের পর তার হাতে থাকা মামলার রায় লেখা শেষ করে জমা দিতে গিয়ে বিফল হওয়া পর এই পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানান তিনি। 

“শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমার যে প্রিজাইডিং বিচারপতি (বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি) আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, তার কাছে আমি গেলাম।”

“উনি স্বভাবতই অপারগতা প্রকাশ করেছেন। উনার এ ছাড়া কিছু করার ছিল না। উনি বলেছেন, ‘দেখেন যেহেতু প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যে অবসরে যাওয়া বিচারপতিগণ আর রায় লিখতে পারবেন না, আর সই করতে পারবেন না-এ অবস্থান থেকে তো উনি সরে যাননি। উনি এখনও ওই অবস্থানে আছেন, সুতরাং আপনার রায় আমি কীভাবে গ্রহণ করি?’”

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা

শামসুদ্দিন চৌধুরীর এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এই বক্তব্য মাননীয় প্রধান বিচারপতির গোচরে এলে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেন যে সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী তার কাছে লিখিত রায় কিংবা আদেশ গ্রহণ করার জন্য জমা দেননি।”

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেলের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আসার আগেই তার আভাস সাংবাদিকদের দিয়েছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, “সম্ভবত রেজিস্ট্রার অফিস থেকে বিভ্রান্তিকর খবর পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।..বিভ্রান্তি এ জন্য বলা হয়েছে, এত সংখ্যক রায় আমার কাছে আছে। এটা বিভ্রান্তিকর এজন্য যে সবগুলো রায় নয়। এগুলোর মধ্যে সিংহভাগ, ৮০ ভাগই ছিল আদেশ। আদেশ এবং রায়ের মধ্যে বিরাট একটা পার্থক্য রয়েছে।”

আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় যুদ্ধাপরাধের মামলার আপিলের শুনানি নিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিনের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির টেলি-কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ গত বছর প্রকাশ হওয়ার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়।

এরপর সেপ্টেম্বরে অবসরে যাওয়ার আগে বিচারপতি শামসুদ্দিন তার পেনশন আটকে দেওয়ার অভিযোগ তুলে প্রধান বিচারপতির অভিশংসন চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে একটি চিঠি দিলে তা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা ওঠে।

অবসর নেওয়ার পর গণমাধ্যমে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে বিচারপতি শামসুদ্দিনের সক্রিয় হয়ে ওঠার মধ্যে গত মাসে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিজের দায়িত্ব নেওয়ার বছরপূর্তিতে দেওয়া এক বাণীতে বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, অবসরের পর রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থি।

তার ওই বক্তব্য ধরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেওয়া রায়ও সংবিধানবিরোধী বলে শোর তোলে। অন্যদিকে সাবেক বিচারপতি, আইনমন্ত্রী, আইনজ্ঞরা প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত জানান।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য এবং পঞ্চদশ সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে বিচার বিভাগের ‘কোন্দল’ প্রকাশ্যে এনে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য বিচারপতি এস কে সিনহাকে দায়ী করে তাকে কথা ‘কম’ বলার পরামর্শ দেন।

‘অপারগ’ হয়ে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়েছেন জানিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথায় আইন প্রণেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ আইনজ্ঞদের মতামতের বিষয়টিও তুলে ধরেন।

“সকলে একবাক্যে বলেছেন যে প্রধান বিচারপতির..এই উক্তি ঠিক নয়, বরং প্রধান বিচারপতি অসাংবিধানিক বেআইনি কথা বলেছেন। আমি আশা করেছিলাম, এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উনি তার পুরনো অবস্থান থেকে সরে যাবেন।”

বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী

কিন্ত তা হয়নি বলেই বলেই চিঠি পাঠিয়েছেন জানিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন বলেন, তার কাছে ১৫টির মতো রায় লেখার বাকি ছিল, যা তিনি ইতোমধ্যে শেষ করেছেন। 

“এখন আমার রায় এবং আদেশ সবই লেখা শেষ হয়ে গেছে। আমি লিখেছি কিন্তু হাতে। আমার টাইপিস্ট, কম্পিউটার, আমরা অফিস স্টাফ সবই উইথড্র করা হয়েছে, যদিও অন্যদের বেলায় করা হয়নি। কিন্তু আমার কোনো স্টাফ নাই, প্রধান বিচারপতি…আমার সব স্টাফ উইথড্র করেছেন।”

অবসরের পর লেখা এসব রায় না নেওয়া হলে কী হবে- সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বিচারপতি শামসুদ্দিন বলেন, “পুনঃশুনানি করতে হবে, সেটি একমাত্র অলটারনেটিভ।

“কিন্তু এখানে বছরের পর বছর লেগে যাবে। এগুলোর শুনানিতে লাগবে, প্লাস এর ফলে অন্যান্য মামলার শুনানিও বিধ্বস্ত হবে। তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কে? বিচারপ্রার্থীরা।”

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কাছে একটি রায় আটকে থাকার অভিযোগও করেন বিচারপতি শামসুদ্দিন।

“পুলিশ কো-অপারেটিভ সোসাইটি মামলায় আমরা চারজন বিচারপতি ছিলাম। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও আমি।”

আমরা তিনজন দেড় বছর আগে এই খসড়ায় (প্রাথমিক দস্তখত) সই করে বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতি সিনহা বাবুর কাছে পাঠিয়েছি। উনি কিন্তু দেড় বছর পরে এটা নামাতে পারেনি, এটা তার কাছেই আছে।”

“আপনার পুলিশ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে এটা নিশ্চিত হতে পারবেন,” সাংবাদিকদের বলেন তিনি।