‘বাবা, ওরা ওর কোনো স্মৃতিচিহ্নই রাখেনি’

শুধু লেখালেখির কারণেই উগ্রবাদীদের চাপাতির কোপে লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে প্রাণ হারাতে হলেও লেখক-প্রকাশক-পাঠকের বইমেলায় নেই তাদের কোনো স্মৃতিচিহ্ন; তা নিয়ে আকুতির সঙ্গে ক্ষোভও ঝরেছে তাদের পরিবার আর পাঠকের কণ্ঠে।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Feb 2016, 01:47 PM
Updated : 3 Feb 2016, 03:01 PM

বইমেলায় দীপনের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতির স্টলটি। সেখানকার পুরো অবয়ব সাজানো হয়েছে তার স্মৃতিকে ঘিরে।

কালো থিমে সাজানো স্টলের সামনে আর ভেতরের অংশে লাগানা হয়েছে দীপনের হাসিমাখা তিনটি ছবি। স্টলের এক কোনায় রাখা হয়েছে তার রক্তমাখা পাণ্ডুলিপি, কলমদানি আর রক্তে ভেজা একটি চটের কিছু অংশ।

বুধবার বিকালে দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক জাগৃতির স্টলে এলে তাকে ঘিরে অনেকটা শোক আর ক্ষোভের আবহ তৈরি হয়।

এ সময় স্টলে বিষন্ন মুখ আর অশ্রুচোখে দাঁড়িয়ে ছিলেন দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আলমগীর শিকদার লোটন তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কিছু কথা বলছিলেন তিনি।

তখন অধ্যাপক ফজলুল হক পুত্রবধূর কাছে এগিয়ে জানতে চান, “কী বলছ জলি?”

স্বামীহারা রাজিয়ার কান্নামিশ্রিত জবাব ছিল, “বাবা, দেখেন, ওরা ওর কোনো স্মৃতিচিহ্নই রাখেনি।”

পুস্তক বিক্রেতা সমিতির সভাপতির উদ্দেশে তিনি বলেন, “দেখেন লোটন ভাই, বাংলা একাডেমি হয়ত কিছু করেনি, একজন প্রকাশক বই প্রকাশ করতে গিয়ে প্রাণ দিল, আপনারা কী করেছেন?

“একদিনের জন্য কালোব্যাজ হলেও ধারণ করতে পারত।”

কিছুক্ষণ পর দীপনের বাবা অধ্যাপক ফজলুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “অভিজিৎ প্রাণ দিল, দীপন প্রাণ দিল, এই মেলায় ওদের জন্য কি কিছু রাখা যেত না?

“বইমেলার মিলনমেলায় যদি আমরা আমাদের লেখক-প্রকাশকদের কিছু করতে না পারি, তাহলে এত এত বিদেশি লেখকের বক্তব্য শুনে কী হবে! বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান কি নিহত লেখক-প্রকাশকদের নাম উচ্চারণ করতে পারতেন না?”

দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ফজলুল হক নিজেও লেখক। অভিজিতের বাবা অজয় রায়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির জন্য তিনিও খ্যাতিমান।

গত বছর বইমেলার ২৬তম দিনে মেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি এলাকায় খুন হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ। ঘাতকের চাপাতির কোপে একটি আঙ্গুল হারান তার সঙ্গে থাকা স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।

এর আট মাসের মাথায় একই বছরের ৩১ অক্টোবর অভিজিতের বই প্রকাশকারী জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা হয়।

লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর কার্যালয়ের হামলায় অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসু গুরুতর আহত হন।

একই কায়দার হামলায় শাহবাগে নিজ কার্যালয়ে নিহত হন জাগৃতির কর্ণধার দীপন। অভিজিতের জনপ্রিয় বই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ছেপেছিলেন তিনি।

দীপনদের ওপর হামলার তিন মাসের মাথায় এল এবার বইমেলা।

জাগৃতি প্রকাশনীর স্টল

মেলায় নিজেদের স্টল সাজানো ও বই প্রকাশে দীপনের স্মৃতি ধরে রাখার সর্বোচ্চটুকু দিয়েছে জাগৃতি।

স্টলে দীপনের ছবিসহ বিলবোর্ডে জীবনানন্দ দাশকে আশ্রয় করে ধর্মান্ধ ও উগ্রবাদীদের আস্ফালনের বিরুদ্ধে উচ্চারণ- ‘অদ্ভুত আঁধার এসেছে এ পৃথিবীতে, আজ যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা’। সেখানের সামনের মূল ব্যানারে ছিল ‘সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক’ স্লোগান।

প্রকাশনার বর্তমান কর্ণধার রাজিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবারের মেলায় তাদের ১৬টি বইয়ের প্রতিটির পেছনে দীপনের ছবিসহ একটি কালোব্যাজ রেখেছেন তারা। তার ছবি সংবলিত একটি চাবির রিংও করা হয়েছে।

“ওই ঘটনার পর আমরা মাত্র তিন মাস সময় পেয়েছি, তবুও দীপনের কাজগুলোকে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।”

পুত্রের স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক ফজলুল হক বলেন, “দীপন তো ধর্মবিরোধী কোনো প্রচারণা চালাতে চায়নি। সে ধর্মবিরোধীও ছিল না। একজন প্রকাশক হিসাবে শুধু বই প্রকাশ করতে চেয়েছিল মাত্র।”

জাগৃতি প্রকাশনীর সামনে এই অধ্যাপককে ঘিরে জটলার মধ্যে কথা হয় তারই ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান সঙ্গে।

জাগৃতি প্রকাশনীর স্টলে ‘জাগ্রত’ দীপন

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “বইমেলা তো লেখক, প্রকাশক আর পাঠকের জন্য। দুজন লেখক ও প্রকাশক বই প্রকাশের জন্যই প্রাণ দিয়েছেন। মেলায় তাদের কোনো স্মৃতিচিহ্ন না রাখা একজন পাঠক হিসাবে আমাকে হতাশ করেছে।”

লেখক অভিজিতের স্মৃতি মনে করার মতো কিছুই মেলায় চোখে পড়েনি। নিহত দুই লেখক ও প্রকাশকের স্মরণে কোনো কিছু করার বিষয়ে এখনো কিছু জানাননি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রকাশকরা।

গত ৩০ জানুয়ারি বইমেলার প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে নিহত লেখক ও প্রকাশকের স্মৃতির উদ্দেশে মেলায় কী থাকছে, তা জানতে চেয়েছিলেন একজন সাংবাদিক।

তখন প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়ে উল্টো লেখক-প্রকাশকদের ‘উস্কানিমূলক’ বিষয় লেখা ও প্রকাশ থেকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।

পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতির সভাপতি লোটন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের জন্য কিছু করতে না পারা আমাদেরকে অপরাধী করে দেয়। বাংলা একাডেমি কিছু করেনি। এখনও তো সময় আছে, আমরা কিছু একটা করব।”

প্রাণহীন শুদ্ধস্বর

মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে টুটুলের প্রকাশনী শুদ্ধস্বরকে অনেকটা প্রাণহীন মনে হয়েছে।

শুদ্ধস্বরের স্টল

মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের উত্তরপাশের এককোণে অবস্থান হওয়ায় স্টলের সামনে মানুষের উপস্থিতি বুধবার বিকালে দেখা যায়নি।

স্টলের সামনে গিয়ে অভিজিৎ আর টুটুলের কোনো স্মৃতিচিহ্ন চোখে পড়েনি। কথা বলতে গেলে বিক্রয়কর্মীরা বলছিলেন, “কেউ তো নেই, কার সঙ্গে কথা বলবেন?”

শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে অভিজিৎ রায়ের ‘সমকামিতা’ শিরোনামের বইটি বেরিয়েছিল আগের বইমেলায়। এর প্রথম সংস্করণ ইতোমধ্যে ফুরিয়ে গেছে।

হামলার পর চিকিৎসাশেষে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ে’ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান আহমেদুর রশীদ টুটুল।

স্টলের বিক্রয়কর্মী সবুজ আলী তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকেই যতটুকু দেখভাল করা যায়, তা টুটুলই করছেন। দেশে এখনো কেউ সেভাবে দায়িত্ব নেননি।

“এখনও কোনো নতুন বই আসেনি। আগেরগুলো স্টলে তুলেছি। এখানে তো মানুষজনও কম।”