সরকারের সঙ্গে শিক্ষকদের আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত শুক্রবার পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। অষ্টম বেতন কাঠামো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আপত্তির বিষয়গুলো কীভাবে নিরসন হবে- সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে, নতুন সপ্তাহের শুরুতেই এ সঙ্কটের সমাধান আশা করছেন তারা।
‘শিগগিরই’ সমাধানের আশার কথা শুনিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা ‘কাছাকাছি’ পৌঁছে গেছেন।
“শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি, কথা বলেছি, ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।”
আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “নানামুখী তৎপরতা আছে। এখনও আমরা ফরমাল মিটিংয়ে বসিনি। আশা করছি, রোববার ফরমাল শেইপ পাবে।”
নয় মাস আগে অষ্টম বেতন কাঠামোর প্রস্তাব আসার পর গ্রেডে ‘মর্যাদার অবনমন’ এবং টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের প্রতিবাদে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের এই আন্দোলনের শুরু।
১৫ ডিসেম্বর নতুন বেতন কাঠামোর গেজেট প্রকাশের পর তাদের আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। সবশেষে ১১ জানুয়ারি শুরু হয় শিক্ষকদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি, যাতে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে পড়ে।
নতুন বেতন কাঠামোর গেজেট প্রকাশের আগে গত ১ নভেম্বর বেতন বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রথম বৈঠক করে। ওই কমিটি প্রথম সভায় যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেতন কাঠামোর গেজেটে তার প্রতিফলন নেই বলে শিক্ষকদের অভিযোগ।
তারা বলছেন, অর্থমন্ত্রী সপ্তম বেতন স্কেলের সুযোগ-সুবিধা না কমিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল, সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের মধ্যে থেকে একটি অংশকে জ্যেষ্ঠ সচিবদের জন্য সৃষ্ট ‘সুপার গ্রেডে’ উন্নীত করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন সপ্তম গ্রেডে সম্ভব না হলে অষ্টম গ্রেড থেকে শুরু করার দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এসবের মধ্যে প্রভাষক থেকে শুরু করে সহযোগী অধ্যাপকদের বিষয়গুলোর সুরাহা হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক ফরিদ বলেন, “এখন অধ্যাপকরা কীভাবে গ্রেড-১ এ যেতে পারে সে বিষয়ে আমরা কথা বলছি।”
অধ্যাপকরা নতুন কাঠামোয় বেতন পাচ্ছেন তৃতীয় গ্রেডে। সেখান থেকে তাদের আর গ্রেড উন্নীতের সুযোগ রাখা হয়নি। যদিও আগের বেতন কাঠামোয় অধ্যাপকদের একাংশ এক পর্যায়ে গ্রেড-১ এ উন্নীত হতেন। সরকারের সচিবরাও ওই গ্রেডে বেতন পান।
বর্তমান পে-স্কেলে সচিবদের বেতন গ্রেড-১ এ নির্ধারণের পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব এবং জ্যেষ্ঠ সচিবদের জন্য দুটি বিশেষ গ্রেড করা হয়েছে, যার অবস্থান গ্রেড-১ এর উপরে।
এর মধ্য দিয়ে অধ্যাপকদের ‘মর্যাদার’ অবনমন হয়েছে দাবি করে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ফরিদ বলেন, “এই বৈষম্য নিরসনের জন্য আগের মতো ২৫ শতাংশ অধ্যাপককে গ্রেড-১ এ উন্নীত করার সুযোগ তৈরি করতে হবে।”
তবে এজন্য টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করতে হবে এমন দাবিতে তারা আর অটল নন। যে কোনো পদ্ধতিতেই তা করা যেতে পারে।
অধ্যাপকদের এই দাবির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে ‘ইতিবাচক সাড়া’ পেয়েছেন বলে দাবি করেন অধ্যাপক ফরিদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আপনারা আমাদের সফট টোন দেখছেন, আশা করি সমাধান হবে।… শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি হোক তাই চাই না। আমরা দ্রুত সমাধান চাই।”
কীভাবে শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান করা হবে সে বিষয়ে মুখ না খুললেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।
শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকের বিষয়টি তুলে ধরে অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, “শিক্ষকদের সমস্যা মিটিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আদেশ জারি করবে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্মতি প্রয়োজন হলে তা দেওয়া হবে। খুব বেশি সমস্যা দেখছি না, নিরসন হবে।”
অবশ্য বেতন কাঠামোর সমাধান শিক্ষা মন্ত্রণালয় কীভাবে করবে- সে প্রশ্ন অধ্যাপক ফরিদেরও।
“শিক্ষামন্ত্রী আমাদের বলেছেন, বিষয়টি তার এখতিয়ারে নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কীভাবে আদেশ জারি করবে? আদেশ তো অর্থ মন্ত্রণালয়কে জারি করতে হবে। এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লেষ আছে।”
আন্দোলন নিয়ে মতবিরোধ?
সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতাদের নিয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন গঠিত হলেও এবারের আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখা গেছে। দাবি কতটুকু পূরণ হলে আন্দোলন শেষ হবে- সে বিষয়ে তৈরি হয়েছে মতভেদ।
ঢাকার বাইরের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতারা বলছেন, কর্মবিরতি শুরুর দুই দিন পর থেকে ফেডারেশনের শীর্ষ নেতাদের সুর ‘নরম’ হতে শুরু করেছে, যার ফল ভালো নাও হতে পারে।
সব দাবি পূরণে ফেডারেশন কার্যক্রম অব্যাহত না রাখলে সংগঠনে ভাঙন ধরতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ঢাকার নেতাদের মতো ‘অত সহজে’ তারা আশাবাদী হতে পারছেন না।
“শিক্ষকদের সব দাবি পূরণ না হলে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা মানবে না।”
অধ্যাপক আনন্দ বলেন, ‘আপসরফায়’ গেলে ফেডারেশেনের সভা ডেকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কারও সঙ্গে বসলে সে দায়িত্ব তার।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “কর্মবিরতি শুরুর পর ফেডারেশনের শীর্ষ নেতারা নরম সুরে কথা বলছেন। আমাদের সব দাবি পূরণ না হলে কর্মসূচি থেকে সরব না।”
‘অন্যদের দাবিরও সুরাহা হবে’
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নয়, নতুন বেতন কাঠামোর ‘বৈষম্য’ নিরসনে আন্দোলনে রয়েছেন ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং ‘নন-গেজেটেড’ কর্মকর্তারা।
প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে জানিয়ে অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, “এ বিষয়ে কাজ চলছে, শিগগিরই সমস্যার নিরসন হবে।”
অষ্টম বেতন কাঠামোয় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালসহ বিভিন্ন ‘বৈষম্য’ নিরসনে এর আগে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক, ২৬টি ক্যাডার ও বিভিন্ন ফাংশনাল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সংগঠন প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি।
এসব দাবি আদায়ে গত ১১ জানুয়ারি থেকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করছেন তারা। এই কর্মসূচি ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চালানোর কথা তাদের।
আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার কর্মকর্তারাও পাঁচ দফা দাবিতে বাংলাদেশ সম্মিলিত সরকারি কর্মকর্তা পরিষদের ব্যানারে ১১ থেকে দিনে দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করে আসছেন।