বুদ্ধিজীবী হত্যায় প্রাণদণ্ড নিজামীর

একাত্তরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নে ভূমিকাসহ তিন অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহালের রায় এসেছে সর্বোচ্চ আদালত থেকে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2016, 01:14 PM
Updated : 6 Jan 2016, 01:14 PM

যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আপিলে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা দ্বিতীয় অভিযুক্ত আসামি।

এর আগে একই অপরাধে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল   আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে গতবছর ২১ নভেম্বর তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।  

নিজামী একাত্তরে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে আল-বদর বাহিনী গড়ে তোলা হলে এর নেতৃত্ব পান নিজামী। তার হাত থেকে সেপ্টেম্বরে দায়িত্ব বুঝে নেন মুজাহিদ। 

এই দুই নেতার নেতৃত্বে আল-বদর বাহিনী সে সময় ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ ঘটনায় বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে  উঠে এসেছে।

২০১২ সালের ২৮ মে যুদ্ধাপরাধের ১৬ ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে মতিউর রহমান নিজামীর বিচার শুরু হয়।

২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল যে রায় দেয় তাতে তাকে আট অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে চারটিতে মৃত্যুদণ্ড এবং চারটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।  বাকি আট অভিযোগে খালাস পান জামায়াত আমির।

সর্বোচ্চ আদালত আপিল আংশিক মঞ্জুর করে বুধবার যে রায় দিয়েছে তাতে ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। ৪ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির রায় এলেও আপিলে নিজামীকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে নিজামীর যে ভূমিকা, তার যে দায়-দায়িত্ব সেটি আজ প্রতিষ্ঠিত হলো।… আজ জাতি সবচেয়ে বড় একটি পাওয়া পেল, সমগ্র দেশবাসী যেটা আগাগোড়া বহু বছর ধরে দাবি করে আসছিল।”

তিন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল

অভিযোগ-২: একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে  ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।

অভিযোগ-৬: নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে যায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।

অভিযোগ-১৬: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির  বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় নিজামীর ভূমিকা ছিল ‘ডি-জুর ও ডি-ফ্যাক্টো’ (প্রচ্ছন্ন ও সরাসরি)।

“অভিযুক্ত তার কৃতকর্মের ফল সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যায় তিনি আলবদর সদস্যদের উৎসাহ, সত্যায়ন, অনুমোদন এবং নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন।”

আদালত মনে করে, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা কেবল অপরাধের ভয়াবহতাকেই বৃদ্ধি করেনি, বরং বাঙালি জাতিকে এক অব্যক্ত ‘ট্রমার’ মুখোমুখি করে। শাস্তির ক্ষেত্রে এ বিষয়টিকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

“দশকের পর দশক ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের স্বজন ও জাতির অব্যক্ত ব্যথার ক্ষেত্রে আইনের ভাষা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। ন্যায় বিচার হচ্ছে সেটাই, যা অপরাধীকে তার কৃতকর্মের ফল শোধ করে দেয়।”

দুই অভিযোগে যাবজ্জীবন বহাল

নির্যাতন ও হত্যার দুটি অভিযোগে আপিল বিভাগ নিজামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড  বহাল রাখে।এগুলো হচ্ছে ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগ।

অভিযোগ-৭: একাত্তর সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে নিজামীর দেওয়া তথ্যে রাজাকার বাহিনীকে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার বৃশালিখা গ্রাম ঘিরে ফেলে মু্ক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ সেলিমের বাবা সোহরাব আলীকে আটক করে। তাকে রাস্তায় নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর স্ত্রী ও সন্তানদের সামনেই হত্যা করা হয়।

অভিযোগ-৮: একাত্তরের ৩০ আগস্ট ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান নিজামী তার সংগঠনের তখনকার সেক্রেটারি আলী আহসান মুজাহিদকে সঙ্গে নিয়ে নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে যান এবং সেখানে আটক মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন বিচ্ছু জালাল, বদি, রুমি (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে), জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করেন। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে নিজামী বলেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। নিজামীর পরামর্শ অনুযায়ী পরে জালাল ছাড়া বাকি সবাইকে হত্যা করা হয়।

আপিলে খালাস তিন অভিযোগে

চূড়ান্ত রায়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও সম্পত্তি ধ্বংসের ঘটনায় ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন নিজামী।

অভিযোগ-৪: নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় রাজাকার বাহিনী পাবনার করমজা গ্রামে  হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ৮ মে নিজামীর রাজাকার ও আলবদর বাহিনী ওই গ্রাম ঘিরে ফেলে নয়জনকে হত্যা করে। রাজাকার বাহিনী একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।

এই অভিযোগে নিজামীকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ-১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালানোর কারণে একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউস ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতী নদীর পাড়ে আরো কয়েকজনের সঙ্গে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ-৩: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ব্যবহৃত হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প হিসাবে। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প খুলে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

শেষ দুটি অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।