রাজীব হত্যা: দুইজনের মৃত্যুদণ্ড, ৬ জনের জেল

গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার রায়ে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র পলাতক রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম দীপের ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2015, 07:10 AM
Updated : 31 Dec 2015, 01:18 PM

এছাড়া একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ পাঁচজনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহম্মেদ তিন বছর আগের এ মামলায় রায় ঘোষণা করেন।

ওই দুজনকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশও দেওয়া হয়েছে।

এ রায়ের মধ্যে দিয়ে দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্লগার ও লেখক-প্রকাশকসহ মুক্তমতের মানুষের ওপর হামলা-হত্যার ঘটনায় প্রথম রায় এলো।

ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার আট আসামির মধ্যে জসীমউদ্দিন রাহমানী ছাড়া বাকিরা সবাই নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।

এদের মধ্যে মাকসুদুল হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক।

বাকি পাঁচজনের মধ্যে এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত।

মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীকে ৫ বছরের কারাদণ্ডসহ দুই হাজার টাকা জরিমানা; অনাদায়ে আরও দুমাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আর সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে ৩ বছরের কারাদণ্ডসহ দুই হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক।

তবে আদালতের এই রায়ে আসামিদের সবার সার্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মামলার বাদী ও রাজীবের বাবা নাজিম উদ্দিন।

আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “মৌলবাদের জয় হলো। আমরা যারা নীরিহ, মুক্তমনা, তাদের পরাজয় হলো।

“হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত ছিল। দুজনের ফাঁসি দিয়ে অপর আসামিদের ১০ বছর, পাঁচ বছর ও তিন বছরের দণ্ড হত্যার সাজা হতে পারে না। এটা প্রভাবিত রায়; রায়ে বিচার বিভাগের ব্যর্থতা বেরিয়ে এসেছে।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, তারাও এ রায়ে ‘পুরোপুরি সন্তুষ্ট’ নন। 

“আমরা সব আসামির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। তাই এই রায়ের কিছু অংশ আমাদের প্রত্যাশার বাইরে। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে বিস্তারিত মন্তব্য করা যাবে।”

আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও জানিয়েছেন, এ রায়ে তারা সন্তুষ্ট নন; আপিল করবেন।

আসামিদের দেওয়া সাজার ব্যাখ্যাও তুলে ধরে রায়ে বলা হয়, দীপের চাপাতির আঘাতে রাজীবের মৃত্যু হয়। এ কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনিক সেই চাপাতি কিনে এনেছিলেন বলে তাকে যাবজ্জীবন দিয়েছে আদালত।

আর আদালতে দেওয়া সাদমান ইয়াসির মাহমুদের ‘জবানবন্দির ভিত্তিতে’ তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।

রায়ে বলা হয়, মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানী যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে হত্যাকাণ্ডে তার নিজের বা অন্য আসামিদের কারও সম্পৃক্ততার কথা আসেনি।

“তবে তার খুৎবায় অনুপ্রাণিত হয়েছে এ সব আসামিরা। যে কারণে তার বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ আসে। তার শাস্তি পাঁচ বছরের।”

এতে বলা হয়, আসামিপক্ষ থেকে কেউ সাজা কমানোর দাবি করেনি; সবাই খালাস চেয়েছেন। কিন্তু খালাস দেওয়ার মতো কাউকে পাইনি। হত্যায় অংশগ্রহণের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

রায় ঘোষণার সময় আসামিদের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যায়নি; কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের বিড় বিড় করতে দেখা যায়।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলা নিয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে ক্ষোভপ্রকাশ করেন বিচারক।  

“তদন্তের গতি অনেক লম্বা হয়েছে। হত্যার আলামত মিললেও তদন্ত কর্মকর্তা চাক্ষুষ কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

তিনি বলেন, “তদন্ত ঠিকমতো হলে রাজীব যে তার বাসা থেকে তার বান্ধবী তানজিলার সঙ্গে বেরিয়ে গেল সেই তানজিলার জবানবন্দি নিতে পারতেন আইও। আমাদের আসলে সবাইকে বিবেক নিয়ে চলতে হবে, ধৈর্য্য নিয়ে চলতে হবে।”

তিন বছর আগে দায়ের হওয়া এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত সোমবার বিচারক রায়ের দিন ঠিক করে দেন।

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর দশম দিনে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পল্লবীতে নিজের বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রাজীবকে।

আহমেদ রাজীব হায়দার(ফাইল ছবি)

এঘটনায় রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিনের করা মামলার তদন্তে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে উঠে আসে।

মামলার তদন্ত শেষে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ ওই আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ। আর এবছরের ১৮ মার্চ তাদের সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে আদালত।

মামলার অভিযুক্ত আটজনের মধ্যে প্রধান আসামি রেদোয়ানুল আজাদ রানা ছাড়া সবাই কারাগারে আছেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, জসীমউদ্দিন রাহমানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে দুটি মসজিদে জুমার খুতবায় ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে এমন ব্লগারদের হত্যার ফতোয়া দিতেন। অন্য আসামিরা সবাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তারা ওই খুতবা শুনতেন। এভাবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হয়।

জসীমউদ্দিনের লেখা বই পড়ে এবং সরাসরি তার বয়ান ও খুতবা শুনে বাকি আসামিরা ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ খুন করতে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত হন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্লগার রাজীব খুন হন। রাহমানকে ওই হত্যাকাণ্ডে উৎসাহদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

পেশায় স্থপতি রাজীব ব্লগ লিখতেন ‘থাবা বাবা’ নামে, যেখানে ধর্মান্ধতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে লিখতেন তিনি।

আসামিদের মধ্যে জসীমকে ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাকিদের গ্রেপ্তার করা হয় তার আগে মার্চ থেকে অগাস্টের মধ্যে।

মুফতি জসীমের উসকানিমূলক খুতবার বিষয়টি ছাত্রদের জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে।

রাজীব হত্যার পর গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, ব্লগার, লেখক-প্রকাশক মিলে ছয় জনকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এর আগে এ ধরনের হামলার শুরু হয় ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি; লেখক-অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে দিয়ে, যিনি পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

গত ১১ বছরের এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে প্রথম কোনো ঘটনার বিচারের রায় হলো।