বিতর্ক-সমালোচনায় নির্বাচন কমিশনের বছর পার

ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে সমালোচনায় বিদ্ধ নির্বাচন কমিশন ২০১৫ সাল শেষ করতে যাচ্ছে পৌর নির্বাচনে বিধিভঙ্গের ঘটনায় ‘ব্যবস্থা না নেওয়ার’ অভিযোগ নিয়ে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2015, 07:20 AM
Updated : 27 Dec 2015, 07:33 AM

ফেলে আসা বছরে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র হিসেবে ‘স্মার্টকার্ড’ দেওয়ার কথা বলে এলেও এক বছরেও তা পারেনি সাংবিধানিক সংস্থাটি।

এছাড়া স্থানীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে দ্বৈত অবস্থান, নারী প্রার্থীদের জন্য গৃহস্থালীর প্রতীক বরাদ্দ, আঠারোর কম বয়সীদেরসহ ভোটার তালিকাভুক্ত করা নিয়ে দ্বন্দ্ব, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংস্কারে মাঠ কর্মকর্তাদের কাছে মতামত চাওয়া, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু করতে না পারা, ভোটের দিন সাংবাদিক নাজেহাল, ভোটে বিধি লঙ্ঘন এবং মাগুরা ও টাঙ্গাইল উপনির্বাচন নিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ইসি।

বছরের শেষ পর্যায়ে এসে তড়িঘড়ি ‘দলভিত্তিক’ পৌর নির্বাচনের আয়োজন করতে গিয়ে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ঘটনায়ও ফুটে উঠেছে ইসির অসহায়ত্ব। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপি- সব পক্ষেরই কঠোর সমালোচনা শুনতে হয়েছে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটিকে।

অবশ্য সব দলই ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কণ্ঠে পাওয়া গেছে স্বস্তির সুর।

তিনি বলেছেন, সবার অভিযোগের মধ্য দিয়েই ইসির ‘নিরপেক্ষতা প্রমাণিত হচ্ছে’। কারণ ইসির ‘নিউট্রাল অবস্থানে’ সবার কিছু না কিছু ‘অসুবিধা’ হচ্ছে।

স্মার্টকার্ডে হতাশা

নাগরিকদের উন্নতমানের ‘স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র’ দিতে এ বছরের শুরুতে ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে ইসি। বছরের বিভিন্ন সময়ে ভোটার হওয়ার নাগরিকদের তা বিতরণের পরিকল্পনার কথা সে সময় জানানো হয়।

মেয়াদের দুই তৃতীয়াংশ সময় পেরিয়ে এসেও স্মার্ট এনআইডি বিতরণ শুরু করতে না পেরে বছর শেষে এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আরও দেড় বছর। ইসি বলছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তারা নাগরিকদের স্মার্ট কার্ড দেবে।

এ প্রসঙ্গে সিইসি বলেছেন, “এটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবে কখন বিতরণ শুরু হবে নির্দিষ্ট তারিখ দিতে পারব না।”

অবশ্য ইসির এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেছেন, “নতুন বছরে দেশের জন্য এ উপহার দিতে পারব আশা রাখি।”

বর্তমানে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকায় সাড়ে ৯ কোটির বেশি নাগরিক নিবন্ধিত রয়েছেন। তাদের পর্যায়ক্রমে স্মার্টকার্ড দেওয়ার কথা রয়েছে।

সিটি ভোট-পৌর ভোট

গতবছর বিএনপির বর্জন আর সহিংসতার মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনে দখল-গোলযোগের ঘটনায় এমনিতেই সমালোচনায় ছিল ইসি। তার রেশ না কাটতেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করাপোরেশেনের ভোট আসে এ বছরের এপ্রিলে।

স্থানীয় সরকারের ওই নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দেয় ইসি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সমর্থিত প্রার্থীদের অংশগ্রহণে দুই নগরীর ভোট সারা দেশেই উত্তাপ ছড়ায়।

তবে ভোটের দিন সেনাবাহিনীকে মাঠে না নামিয়ে সেনানিবাসে রাখা, ভোট কেন্দ্রে সাংবাদিকদের হয়রানি এবং অনিয়ম-জালিয়াতির অভিযোগ শেষ পর্যন্ত সব আলোচনাকেই ছাপিয়ে যায়।

গৃহস্থালীর বিভিন্ন সামগ্রীর ছবি নারী প্রার্থীদের জন্য প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ করায় সিটি নির্বাচনে ইসির সমালোচনা হয়, যার ধারাবাহিকতা দেখা গেছে পৌর নির্বাচনেও।

‘অসাবধানতাবশত’ এমন প্রতীক রাখা হয়েছে জানিয়ে আগামীতে তা পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়েছে ইসি।

বছরের শেষভাগে পৌর নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যস্ততা শুরু হলেও সরকার এবার দলভিত্তিক নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যায় ইসি।

এরইমধ্যে দ্রুততার সঙ্গে আইন ও বিধি সংশোধন হয়, ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন রেখে ঘোষণা হয় তফসিল। বিএনপি- জাতীয় পার্টির ভোট পেছানোর দাবিতে সাড়া না দিয়ে এগিয়ে যায় ইসি।

ভোটের প্রচারের মাঠে সাংসদ ও দলীয় প্রার্থীদের একের পর এক বিধি ভঙ্গের ঘটনায় ইসি ও মাঠ কর্মকর্তারা কার্যত ‘দিশেহারা’ হয়ে পড়লেও খুব বেশি কঠোর হতে দেখা যায়নি কমিশনকে। 

এর সমালোচনা করে জাতীয় পার্টি ইসিকে বলেছে ‘মেরুদণ্ডহীন’, বিএনপি বলেছে ‘সরকারের আজ্ঞাবহ’। অন্যদিকে ইসি কয়েকজনকে জরিমানা করায় আওয়ামী লীগ কমিশনকে বলেছে ‘নির্দয়’।

গত একটি বছরে ইসির কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে কমিশন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা অবশ্যই মনে করি, নির্বাচন কমিশন সফল হয়েছে। তবে আরও ইমপ্রুভ করতে হবে, যাতে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করা যায়।”

নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, “সব কিছু মিলিয়ে এ বছরটা নির্বাচন কমিশনের ভালোই কেটেছে। হয়ত দুয়েকটি বিষয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে। প্রতিটি নির্বাচন ও উদ্যোগই আমরা সুষ্ঠু ও সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছি।”

হজ নিয়ে মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগের সদস্যপদ খোয়ানো আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর সাংসদ পদ নিয়ে ফয়সালার বিষয়টিও এ বছর ইসিতে গড়িয়েছে।  

আওয়ামী লীগ লতিফের সাংসদ বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিলে সাবেক এই টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আদালতে যান। আদালতে তা খারিজ হওয়ায় ইসির শুনানিতে গিয়ে ইস্তফা দেওয়ার কথা বলেন টাঙ্গাইল থেকে সংসদে আসা সিদ্দিকীদের বড় ভাই লতিফ। পরে তিনি সংসদে গিয়ে স্পিকারের হাতে পদত্যাগপত্র দেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ মঙ্গলবার দেশের ২৩৪ পৌরসভায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক

কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর আগে ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের কিছু নির্বাচনের সূচি রয়েছে তাদের হাতে।

সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে ভোট আয়োজন এবং স্মার্টকার্ড বিতরণ শুরুর আশা নিয়েই মেয়াদের শেষ দিনগুলো শুরু করতে যাচ্ছে কাজী রকিবের ইসি।