নাম দিয়ে যেন ভুলে গেছে সবাই

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়কের নামকরণ হলেও ‘শর্টকার্ট খোঁজার অভ্যাসে’ বিস্মৃতির অতলে হারাতে বসেছে সেসব নাম।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2015, 02:43 AM
Updated : 14 Dec 2015, 05:18 AM

শহীদ পরিবারের সন্তানরা বলছেন, জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতি ধরে রাখতে নামগুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে; বাধ্যতামূলক করতে হবে সঠিক নাম ব্যবহার।

এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এএনএম মুনীরউজ্জামানের সন্তান আবু মুসা ম. মাসুদউজ্জামানের সঙ্গে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “টিএসসি থেকে শহীদ মিনারের দিককার সড়কের নাম যে শহীদ মুনীর চৌধুরী সড়ক তা কি কেউ জানে?

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের টাওয়ার ভবনের বাবার নামে (এএনএম মুনীরুজ্জামান ভবন) নামকরণ করা হলেও সেটাকে আগের নামেই তো ডাকা হয়।”

তবে টাওয়ার ভবনসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের নাম শহীদ শিক্ষকদের নামে করায় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিয়ে নতুন নামে ডাকার জন্য সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির এই সভাপতি।

ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব মার্টায়ার্স ইন্টেলেকচুয়ালস, ফ্রিডম ফাইটার্স অ্যান্ড শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি মাসুদউজ্জামান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল কাগজপত্রে বাধ্যতামূলকভাবে সঠিক নামে লেখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে অন্যরাও ক্রমান্বয়ে সেগুলোকে নতুন নামে ডাকবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে তিনটি ভবনের নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামে থাকলেও তার দুটি আগের নামেই পরিচিত।

এর মধ্যে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবনকে আগের মতো ‘দক্ষিণ বাড়ি’ এবং গোবিন্দচন্দ্র দেব ভবনকে ‘উত্তর বাড়ি’ নামেই ডাকা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. অসীম সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জগন্নাথ হলের পুকুরকে কেন্দ্র করে আগে থেকে এই ভবনগুলোর উত্তরবাড়ি বা দক্ষিণবাড়ি নামে পরিচিত। তবে অফিসিয়ালি কোথাও কিন্তু আমরা এটা ব্যবহার করি না। কোনো সাইনবোর্ডেও কিন্তু এটা লেখা নাই।”

“তবুও যে নামে আগে ডাকা হতো সেটা চলে আসছে। নতুন নামে ডাকা বা পরিচিত করানোর জন্য আমাদের সচেতন হওয়ায় দরকার।”

তিনি বলেন, “আগে ‘পূর্ব বাড়ি’ নামে পরিচিত সন্তোষচন্দ্র চন্দ্র ভবন ভেঙ্গে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে নির্মিত নতুন ভবন করা হয়েছে। সেটাকে কেউ এখন আর ‘পশ্চিম বাড়ি বলছে না, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনই বলছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক চিশতি শাহ হেলালুর রহমানের নামে একটি পাঠকক্ষ থাকলেও এখনও সেটি ‘এক্সটেনশন রিডিং রুম’ নামেই পরিচিত।

আবার শহীদ শিক্ষক আবুল খায়েরের নামে ওই হলের মিলনায়তনের নামকরণ হলেও সেটাকে ডাকা হয় ‘হল অডিটোরিয়াম’ নামে।

জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অফিসিয়ালি আমরা নতুন নামই ব্যবহার করি। কিন্তু ডাকার জন্য শর্টকার্ট খোঁজার অভ্যেস আমাদের আছে। তাই সঠিক নামে ডাকা হয় না।”

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সচেতন হলে ক্রমান্বয়ে শহীদদের নামে ডাকার সংস্কৃতি চালু হবে বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এই গবেষক।

এ তো গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ‘নামসর্বস্ব’ নামকরণের বৃত্তান্ত। অন্যান্য সড়ক ও স্থাপনার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে একই চিত্র।

মগবাজার থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত সড়কের সরকারি নাম ‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক’ হলেও এই নামে চেনা লোকের সংখ্যা খুব বেশি হবে না।

এলাকাবাসীরা জানান, নতুন নামে তারা অভ্যস্ত নন। তাই তারা এটাকে মগবাজার-মৌচাক কিংবা মৌচাক-মগবাজার সড়ক নামেই ডাকেন ও চেনেন।

সরেজমিন ঘুরে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কের দুই পাশের বেশিরভাগ দোকান বা স্থাপনার ঠিকানায় দুটি নাম পাওয়া গেছে।

মগবাজার থেকে মৌচাকগামী সড়কের আগের নাম ‘নিউ সার্কুলার রোড’ আর মৌচাক থেকে মগবাজারগামী সড়কের নাম ‘আউটার সার্কুলার রোড’।

নতুন নাম মানুষের কাছে স্বল্প পরিচিত হওয়ায় দোকানের ঠিকানায় ‘আউটার সার্কুলার রোড’ লিখেছেন বলে জানান ওয়ারলেস রেলগেটে আল-ইসলামিয়া জেনারেল স্টোরের ব্যবস্থাপক আতাহারুল ইসলাম।

“নতুন নাম দিলে তো মানুষ চিনব না, তাই আমরা পরিবর্তন করি নাই।”

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কের মগবাজার থেকে মৌচাকগামী অংশেও পুলিশের রমনা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার কার্যালয়সহ বিভিন্ন ভবন ও দোকানের ঠিকানায়ও আগের মতো ‘নিউ সার্কুলার রোড’ লেখা দেখা গেছে।