পদ্মায় স্বপ্নপূরণের ‘আসল যজ্ঞ’ শুরু

দেশের দক্ষিণ জনপদকে সড়কপথে সরাসরি রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করতে দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে পদ্মায় সেতু নির্মাণের যে স্বপ্নের সূচনা হয়েছিল, এবার তাকে চূড়ান্ত আকৃতি দেওয়ার কাজ শুরু হল।

রিয়াজুল বাশার জাজিরা (শরীয়তপুর) থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2015, 08:20 AM
Updated : 12 Dec 2015, 01:44 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার জাজিরায় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নদীশাসন এবং পরে মাওয়ায় সেতুর মূল কাজের উদ্বোধন করেন।

মাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর এক কিলোমিটার ভেতরে শুরু হয় সাত নম্বর পিলারের মূল পাইলিংয়ের কাজ। এরকম মোট ৪২টি পিলারের ওপর ভর দিয়েই প্রমত্তা নদীর দুই তীরকে যুক্ত করবে পদ্মা সেতু।

সরকার আশা করছে, ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু আগামী তিন বছরের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে। সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেনও চলবে।

জাজিরায় নদীশাসন কাজের উদ্বোধনের পর এক সুধী সমাবেশে নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি- আমরা তা দেখাব।… আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি।”

এই সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ‘মিথ্যা অভিযোগ’ এবং নানা বাধা-বিপত্তির কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালি জাতি কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না।

“আমরা সেই জাতি, যে জাতি সম্পর্কে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না’, আজকেও সেটি প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।”

প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই সেতু দিয়ে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলা।

এ সেতু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে, প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হবে বলে আশা করছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে মাওয়া ও জাজিরার পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে নানা রংয়ের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ডে ছেয়ে ফেলা হয় পুরো প্রকল্প এলাকা।

সকাল পৌনে ১০টার দিকে হেলিকপ্টারে করে প্রধানমন্ত্রীর জাজিরায় পৌঁছানোর কথা থাকলেও কুয়াশার কারণে তা বিলম্বিত হয়। পৌনে এক ঘণ্টা পর নাওডোবা মৌজায় হেলিপ্যাডে নেমে কয়েকশ গজ দূরে নদীশাসন কাজের ফলক উন্মোচন করেন তিনি।

জাজিরার অনুষ্ঠান শেষে নদীপথে অন্য পাড়ের মাওয়ায় পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। পথে নদীর মধ্যে সাত নম্বর পিলারের পাইলিং কাজের জায়গাটিও দেখেন তিনি।

মাওয়ায় এসে সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের পাশে নিয়ে বোতাম চেপে পদ্মা মূল সেতু নির্মাণ কাজের ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।

এ সময় তিনি সবার কাছে দোয়া চান, যেন ‘সময়মত’ নির্মাণ কাজ শেষ করা যায়।

সেতুর মূল দুই নির্মাণ কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে। মূল অনুষ্ঠানস্থলের বহু দুরেও দেখা যায় ভিড়।

পদ্মা সেতু নির্মাণে যারা ভিটে-মাটি ও জমি দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে তাদের জীবন-মানের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখারও প্রতিশ্রুতি দেন।

পদ্মা সেতুর পাইলিংয়ের জন্য প্রস্তুত সব সরঞ্জাম। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক

বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, শিল্প মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন, নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমান ও ইকবাল সোবহান চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জাজিরা ও মাওয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

আরও ছিলেন সেনা প্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, পুলিশের আইজি শহীদুল হক, চিফ হুইপ আসম ফিরোজ, স্থানীয় সাংসদ সুকুমার রঞ্জন ঘোষ ও সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, দীপু মনি, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে পুনরায় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে আসে বিশ্ব ব্যাংক।

কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে থাকে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র মূল্যায়ন করে পাঁচ দরদাতাকে বাছাই করে তা বিশ্ব ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হলেও সংস্থাটি তা ঝুলিয়ে রাখে।

এরপর পদ্মা সেতুতে ‘সম্ভাব্য’ দুর্নীতির’ অভিযোগ আনে বিশ্ব ব্যাংক। দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংককে ‘না’ বলে দেয়। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন জানায়, দুর্নীতির কোনো প্রমাণ তারা পায়নি।

শেষ পর্যন্ত নকশা অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের জুনে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানিকে মূল সেতু নির্মাণের কাজ এবং সিনো হাইড্রো করপোরেশনকে নদী শাসনের কাজ দেওয়া হয়।

পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের মূল কাজের উদ্বোধন হচ্ছে শনিবার। এ উপলক্ষে নতুনভাবে সাজছে পদ্মাপাড়। ছবিটি বৃহস্পতিবার মাওয়া থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, প্রকল্পের প্রায় ২৭ শতাংশ কাজ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। এই সেতু নির্মাণের পাশাপাশি মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত চার লেইনের সড়ক হবে। রাজধানীর বিজয়নগর থেকে ঢাকা-মাওয়া সড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে হবে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার।

এছাড়া জাজিরা পয়েন্ট থেকে খুলনা, বেনাপোল, কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেইনের সড়ক নির্মণের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আশিক হোসেন ও সাজিদুল হক]