একদিনে ২৯ জনের ফাঁসির রায়

একদিনে ২৯ জনের ফাঁসির রায় হয়েছে বাংলাদেশের ছয় জেলায়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2015, 01:40 PM
Updated : 30 Nov 2015, 04:24 PM

সোমবার দেওয়া এসব রায়ের মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কুষ্টিয়ার হত্যা মামলায় রায় এসেছে বিচারিক আদালত থেকে।

আর ঢাকার পোস্তগোলা এলাকার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম হত্যা মামলার রায় এসেছে উচ্চ আদালত থেকে। আপিলের রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামির মধ্যে পাঁচজনের ফাঁসি বহাল রেখে একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

গাজীপুরে একটি হত্যামামলায় মৃত্যুদণ্ড হয়েছে ১১ জনের। নারায়ণগঞ্জে দুটি মামলায় পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

চট্টগ্রামে এক মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে চারজনের। সিলেটে এক শিশু হত্যার দায়ে তিনজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যার চার বছর পর স্বামীর মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

গাজীপুর: এক যুগ আগে যুবলীগ নেতা জালাল উদ্দিন সরকারকে হত্যার দায়ে ১১ জনের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. ফজলে এলাহী ভূঁইয়া।

সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া ১১ আসামির মধ্যে ছয়জন রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। এরা হলেন- ফরহাদ সরকার, বেলায়েত হোসেন বিল্টু, ফারুক হোসেন, আতাউর রহমান, জয়নাল আবেদীন ও আহমদ আলী।

এছাড়া জজ মিয়া, আলামিন, মাহবুবুর রহমান, আহিম ফকির ও জুয়েল মামলার শুরু থেকেই পলাতক।

যুবলীগ নেতা জালাল উদ্দিন সরকার

মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি আসামিদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন বিচারক।

দণ্ডিতরা সাত দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন বলে আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. রবিউল ইসলাম জানান।

২০০৩ সালে বলখেলা বাজার এলাকায় কাপাসিয়া উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি জালাল সরকারকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

নারায়ণগঞ্জ: দুই বছর আগে স্কুলছাত্র রাকিবুল ইসলাম ইমনকে অপহরণ ও হত্যার দায়ে চারজনের মৃত্যুদণ্ড দেন নারায়ণগঞ্জের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মিয়াজি মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম।

এছাড়া সাত বছর আগে স্কুলছাত্রী সোনিয়া আক্তার সাজেদা ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় একজনের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক কেএম রাশেদুজ্জামান রাজা।

রাকিবুল ইসলাম ইমন

রাকিবুল ইসলাম ইমন সোনারগাও উপজেলার মোগরাপাড়া এলাকার এইচজিএস স্মৃতি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। সোনিয়া ঢাকার মাতুয়াইল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়তেন।

ইমন হত্যা মামলার নথি থেকে জানা যায়, বন্দর উপজেলার কামতাল মালিভিটা গ্রামের ইমনকে এলাকা থেকে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি রাতে অপহরণ করা হয়। এরপর ইমনের মা ফেরদৌসী বেগমের কাছে মোবাইল ফোনে দুর্বৃত্তরা ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

একই বছরের ৬ মার্চ এলাকার একটি মুরগির খামারের ডোবায় প্লাস্টিকের বস্তায় ইমনের গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়।

সন্তান নিখোঁজের পর ওই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ফেরদৌসী বেগম (৩২) বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। মামলায় কামতাল মালিভিটা গ্রামের চারজনকে আসামি করা হয়।

পরে পুলিশ ঘটনার অনুসন্ধান চালিয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে ওই গ্রামের আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করে, যাদের মধ্যে তিনজন ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। তাৎক্ষণিকভাবে দণ্ডিত চারজনের নাম জানা যায়নি।

নারায়ণগঞ্জ আদালতে রায়ের আগে সন্তানের ছবি হাতে ইমনের মা

এদিকে সোনিয়া হত্যা মামলার রায় ঘোষণার সময় দণ্ডিত দেলোয়ার হোসেন আদালতে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর রাকিব উদ্দিন রাকিব। 

এই মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০০৮ সালের ২৯ অগাস্ট স্কুলে যাওয়ার পথে সোনিয়াকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দেলোয়ার হোসেন নারায়ণগঞ্জ শহরের সিরাজদৌল্লাহ সড়কে দাদা আবাসিক হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে দেলোয়ার হোসেন ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

ওই ঘটনায় নিহতের মা সাবিনা ইয়াসমিন বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।

চট্টগ্রাম: বোয়ালখালী উপজেলায় এক চালককে খুন করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের দায়ে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের এ আদেশ দেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালের বিচারক সৈয়দা হোসনে আরা।

সাত বছর আগের এই হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া চার আসামি হলেন- নুরুল আলম, আবুল কালাম, মো. কাউসার ও মো. রুবেল। এদের মধ্যে কাউসার ছাড়া বাকিরা পলাতক।

আর যাবজ্জীবন সাজার আদেশ হয়েছে আরিফুল ইসলাম ও এস এম নইমউদ্দিন নামের দুই জনের। তাদের মধ্যে আরিফ পলাতক।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০৮ সালের ৩ মে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকা থেকে আনোয়ারার মোহছেন আউলিয়ার ‍মাজারে যাওয়ার কথা বলে ইউসুফ নামের এক চালাকের অটোরিকশা ভাড়া নেয় আসামিরা। পরে বোয়ালখালীর পশ্চিম গোমদণ্ডি এলাকায় ইউসুফকে খুন করে লাশ রাস্তায় ফেলে তারা অটোরিকশা নিয়ে চলে যায়।

পরে অটোরিকশার মালিক সাতকানিয়া থেকে তার বাহন উদ্ধার করেন। স্থানীয়রা পাঁচজনকে ধরে পুলিশের সোপর্দ করে।

ইউসুফের খালাতো ভাই হাশেম পরে বোয়ালখালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। তদন্ত শেষে পুলিশ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।

সিলেট:  শিশু আবু সাঈদ হত্যা মামলায় তিনজনের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুর রশিদ।

ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি আব্দুল মালেক জানান, দণ্ডিতদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছেন বিচারক। জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে আরও তিনমাস করে কারাভোগ করতে হবে তাদের।

আবু সাঈদ

দণ্ডিতরা হলেন সিলেট বিমানবন্দর থানার বরখাস্ত পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান পুতুল, সিলেট জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম ওরফে আব্দুর রাকিব ও পুলিশের কথিত সোর্স আতাউর রহমান গেদা।রায়ের সময় আসামিরা সবাই আদালতে ছিলেন।

অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় ওলামা লীগ নেতা মাহিব হোসেন মাসুমকে খালাস দেওয়া হয়।

মামলার বিবরণে দেখা যায়, চলতি বছরের ১১ মার্চ সিলেট নগরীর শাহ মীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবু সাঈদ অপহৃত হয়। পরে অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

এরপর ১৪ মার্চ রাতে নগরীর ঝর্নার পাড় সুনাতলা এলাকার একটি বাসা থেকে সাঈদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।পরদিন সাঈদের বাবা আব্দুল মতিন কোতোয়ালি থানায় মামলাটি করেন।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর চারজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এর মধ্যে তিন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

কুষ্টিয়া: দৌলতপুরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যার চার বছর পর স্বামীর মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক রেজা মো. আলমগীর হাসান।

দণ্ডিত রোকন মণ্ডল দৌলতপুর উপজেলার নাজিরপুর গ্রামের হুলি মণ্ডলের ছেলে। রায় ঘোষণার সময় তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান আদালতের পিপি অনুপ কুমার নন্দী।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৬ অগাস্ট রাতে ভ্যানচালক রোকন মণ্ডল জুয়া খেলে বাড়ি ফিরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী লাইলী খাতুনের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে রোকন তার স্ত্রীকে বাড়ির পাশে নিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ ড্রেনে ফেলে দেয়। দুইদিন পর ওই ড্রেন থেকে পুলিশ লাইলীর গলিত লাশ উদ্ধার করে।

নিহতের বাবা লাল চাঁদের দায়ের করা মামলায় পুলিশ রোকনকে গ্রেপ্তার করে। পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে রোকন স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করে।

জাহাঙ্গীর হত্যা: স্ত্রীসহ ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল

রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম হত্যা মামলায় তার স্ত্রী নাট্যশিল্পী সুমাইয়া কানিজ সাগরিকাসহ পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে হাই কোর্ট।

সাগরিকা ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি চার আসামি হলেন- ইব্রাহীম ওরফে ইয়াছিন (২৯), হিজরা খলিল (২২), আল আমিন ও খলিল শেখ।  তারা সবাই কারাগারে রয়েছেন।

বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আলী আশরাফ লিটনের অপরাধ ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায়’ হাই কোর্ট তাকে খালাস দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট

নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল এবং ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) শুনানি শেষে বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকার ও বিচারপতি এ এন এম বশিরউল্লাহর হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়।

ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১০ সালের ২১ জুন এ মামলার রায়ে ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।

নিম্ন আদালতের ওই রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাই কোর্টে আসে। পাশাপাশি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করেন।

চলতি বছরের ৮ নভেম্বর থেকে ২৯ নভেম্বর হাই কোর্টে এ মামলার শুনানি চলে। রায় ঘোষণা হল ৩০ নভেম্বর।

২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর খুন হন লোহা ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম। তিনি শ্যামপুরের আরসিন গেইট এলাকার এক বাসায় স্ত্রী সাগরিকা এবং তিন মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন।

জাহাঙ্গীরের বাবা ফিরোজ আলম ওই ঘটনার পর সাগরিকাসহ সাতজনকে আসামি করে শ্যামপুর থানায় মামলা করেন।

এজাহারে বলা হয়, অভিনেত্রী সাগরিকার ‘বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক’ ছিল এবং তাদের দিয়েই তিনি জাহাঙ্গীরকে খুন করান।