এরপর ‘হেব্বি পেটাবো’: মেয়র আনিসুল

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ট্রাকস্ট্যান্ডে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে কেউ সেখানে জনদুর্ভোগের কারণ ঘটালে তাদের কোনো ছাড় না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র আনিসুল হক। 

আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2015, 12:35 PM
Updated : 30 Nov 2015, 05:37 PM

আগের দিন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা কার্যত অবরুদ্ধ থাকার পর বিপুল সংখ্যক পুলিশ-র‌্যাবের পাহারায় বেরিয়ে আসা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র সোমবার ঘটনাস্থলের আধা কিলোমিটারের মধ্যের একটি অভিজাত হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন।

ওই অভিযানের সময় বিক্ষুব্ধ পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশ ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের অফিসে মেয়রের ‘অবরুদ্ধ’ হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও তা উড়িয়ে দেন আনিসুল হক।

কারওয়ান বাজারের লা ভিঞ্চি হোটেলে ‘জন দুর্ভোগ নিরসনে উচ্ছেদ কার্যক্রম’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “গতকাল যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তাতে যে কারও মনে হবে মেয়র হয়ত অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। এটির কারণে কিছু কনফিউশন তৈরি হয়েছে। গণমাধ্যমেও বলা হয়েছে, মেয়র দুই ঘণ্টা ঘরে।

“আমাদের কাছে প্রচুর ফোর্স ছিল, তারা মব ক্লিন করে দিতে চেয়েছিল। আমি বারবার বলেছি, না কারও গায়ে হাত দেবেন না। এখানে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, শ্রমিকদের ভুল বোঝানো হয়েছে। পরে কিন্তু আমি বের হয়েছি। শ্রমিকদের সাথে কথাও বলেছি। তারা হাততালি দিয়েছে।”

রোববার দুপুরে মেয়র স্ট্যান্ডের বাইরে সড়কে রাখা ট্রাক বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে চাইলে শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তখন পুলিশ লাঠিপেটা ও কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ার পাশাপাশি ফাঁকা গুলিও চালায়। এতে এক শ্রমিকের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে, মেয়র আটকা পড়েন।   

রোববার উচ্ছেদ চালাতে গিয়ে আটকে পড়ার তিন ঘণ্টা পর পুলিশ-র‌্যাবের পাহারায় মেয়র আনিসুল হক বেরিয়ে আসছেন

উচ্ছেদে কারা বাধা দিয়েছিল- জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, “মেয়রকে বাধা দেওয়ার শক্তি তাদের নেই। কিছু নেতা, যারা দীর্ঘদিন ওই এলাকা থেকে অবৈধভাবে টাকা তোলেন, তারাই ঝামেলা করতে চেয়েছে। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল মেরেছে।

“পরে আমি একা গেছি, বলেছি আমার গায়ে ঢিল মারো। কেউ মারেনি। এদের মধ্যে কিছু ইমপোর্টেড (বাইরের) শক্তি আছে। সব কথা এখানে বলা সম্ভব নয়। এরা হলেন অবৈধ শক্তি, মাদক ব্যবসার শক্তি।”

ভবিষ্যতেও কেউ সড়ক দখলের চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার হুঁশিয়ারি দেন ব্যবসায়ী নেতা থেকে এক ফুঁ-য়ে জনপ্রতিনিধি বনে যাওয়া আনিসুল হক। তিনি বলেন, “এখানে যদি আর কেউ কোনো কিছু করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের হেব্বি পেটানো হবে।” 

রোববার উচ্ছেদে ‘ঝামেলা’ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি, হামলাকারীদের শনাক্ত করতে। হামলাকারীদের খবর হয়ে যাবে। পুলিশ কমিশনারকে অনুরোধ করেছি, যারা ঝামেলা করেছে তাদের অবশ্যই ধরতে হবে। তিনি আশ্বস্ত করেছেন।”

হামলায় মেয়রের প্রটোকলের একটি গাড়িসহ সিটি কর্পোরেশনের ১৫টি গাড়ি ও যন্ত্র ভাংচুর এবং সাতজন চালক আহত হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। রোববারের সংঘর্ষের পর ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানিয়েছিলেন, কাউকে গ্রেপ্তার করেনি ‍পুলিশ।  

অভিযানের সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ

উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আমন্ত্রণপত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের থাকার কথা জানানো হলেও অভিযানে শুধু রেলমন্ত্রী ছিলেন।

তেজগাঁও এলাকার সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান কামাল এবং পরিবহন শ্রমিকদের নেতা শাজহান খান অভিযানের সময় ছিলেন না। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক উপস্থিত হলেও মেয়রকে ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের অফিসে রেখে চলে যান।

হামলার ঘটনায় কোনো মন্ত্রীর ইন্ধন ছিল বলে মনে করেন কি না- প্রশ্ন করা হলে আনিসুল হক বলেন, “এটা আমি জানি না। কোনো মিনিস্টার জড়িত, এটা আমি মনে করি না।”

ট্রাকস্ট্যান্ডে কতগুলো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় সব অবৈধ স্থাপনাই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

“এখন রেলের জমিতে সাত/আটটি ঘর রয়েছে। আমি রেলমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি, যারা দখলে রেখেছে তারা বেশ প্রভাবশালী, রেলমন্ত্রী এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।”

“রাস্তায় যেন আর ট্রাক দাঁড়াতে না পারে এটি দেখার দায়িত্ব পুলিশ প্রশাসনের। আমি কমিশনারকে বলেছি, তিনি বলেছেন পুলিশ এটি লক্ষ্য রাখবে। বাকি দায়িত্ব তাদেরকেই পালন করতে হবে।”

“স্ট্যান্ডে পাঁচটি এক্সিট পয়েন্ট, সবগুলোই দখল হয়ে ছিল। যার কারণে একটি রাস্তা দিয়ে ট্রাক ঢুকত। আমরা পাঁচটি রাস্তাই পরিষ্কার করে দিয়েছি। চালক ও মালিকরা এখন থেকে এই রাস্তাগুলো ব্যবহার করে ট্রাক আনা-নেওয়া করতে পারবেন,” বলেন মেয়র।

উচ্ছেদ অভিযানের সময় শ্রমিকদের শান্ত করতে বক্তৃতায় মেয়র আনিসুল হক

বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের শান্ত করতে আগের দিন আধুনিক ট্রাকস্ট্যান্ড নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন আনিসুল হক। সেটা কোথায় হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা তেজগাঁওয়ে হবে না। ঢাকার বাইরে জায়গা দেখার চেষ্টা করছি।”

সংঘর্ষের সময় সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনায় নিন্দা ও দুঃখ প্রকাশ করেন মেয়র।

মেয়রের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী বলেন, গতকাল যে অভিযান, সেটা ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদের অভিযান ছিল না, বরং এর ভেতরে অবৈধ স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেওয়ার অভিযান ছিল।

“আমরাই বলেছিলাম, জায়গাটা পরিষ্কার করে দিলে ভেতরে ট্রাক রাখা যাবে। আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে আর কখনও রাস্তায় ট্রাক থাকবে না। শৃঙ্খলা ফিরে আসলে কাজের গতিশীলতাও ফিরে আসবে।”

কাওরান বাজার এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সফিউল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “স্ট্যান্ডের সামনের রাস্তায় এখন কোনো ট্রাক নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না।”

একদিন বাদেই পাল্টে গেল চিত্র

আগের দিন মেয়রের উচ্ছেদ অভিযানের পর সাতরাস্তা থেকে কারওরান বাজার রেলক্রসিং যাওয়ার পথটিতে সোমবার কোনো ট্রাক থামিয়ে রাখতে দেখা যায়নি। এর আগে থেমে থাকা ট্রাকের জন্য এই রাস্তাটিতে চলাচলে সমস্যা হত।

সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সড়ক থেকে ট্রাক ও কভার্ডভ্যান সরিয়ে নিয়েছেন চালকরা।

বাংলাদেশ ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ১০দিন ধরেই আমরা এ এলাকাটি পরিষ্কার করছি। গতকাল ভেতরের অবৈধ স্থাপনাগুলো ভেঙে দেওয়ায় এখন ভেতরেই ট্রাক রাখা হবে।”

স্থাপনা উচ্ছেদ (রোববারের ছবি)

ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অনেক কাল আগে থেকে এখানে ট্রাক রাখা হচ্ছে।

“এর মধ্যে শহর বেড়েছে, শিল্প কারখানা বেড়েছে, ট্রাকও বেড়েছে। টার্মিনালে জায়গা না থাকায় এতদিন রাস্তায় ট্রাক রাখা হত।”

টার্মিনালের ভেতরে বেশ কিছু ঘর হয়ে যাওয়ায় ট্রাক রাখার জায়গা সঙ্কটের কারণে সড়কে ট্রাক রাখা হচ্ছিল বলে দাবি করেন তিনি।

“আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা। আমাদের গাড়িগুলো যেন সুশৃঙ্খলভাবে রাখা যায়, আমরা এটা আশা করি।”

কয়েকজন শ্রমিক নেতার ছত্রছায়ায় জায়গা বেদখল হয়েছে বলে দাবি করেন চালকদের নেতা সিরাজ।

ট্রাক স্ট্যান্ডে কোনো ধরনের স্থাপনার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও তিনি মনে করেন, ভেতরে মেকানিকদের জন্য ছোট করে কাজ করার ব্যবস্থা রাখা উচিত।