‘ধূমপান-পকেটে মোবাইলে বাড়ছে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি’

ধূমপান ও মোবাইলের রেডিয়েশনে পুরুষের বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ভারতীয় প্রজনন বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগীর।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2015, 03:57 PM
Updated : 27 Nov 2015, 04:11 PM

চট্টগ্রামের বিখ্যাত খাস্তগীর পরিবারের এই সন্তান শুক্রবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পুরুষদের ধূমপান প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

পুরুষরাই বিশ্বজুড়ে বন্ধ্যাত্বের ৬০ ভাগের কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, প্যান্টের পকেটে মোবাইল রাখার ফলে সৃষ্ট রেডিয়েশন এবং ধূমপানের কারণে পুরুষের বন্ধ্যাত্ব আরও বাড়ছে।

তিনি বলেন, “অন্ডকোষের জন্য একটি খারাপ বিষয় হচ্ছে ধূমপান। অন্ডকোষের জন্য এটা এত খারাপ, বললে আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না-এক বছর ধূমপান করলে অন্ডকোষের বয়স ১০ বছর বেড়ে যায়।

“ধরেন, আপনার বয়স ২৫। ১ বছর ধূমপান করার পর ২৬ বছর বয়সে আপনার অন্ডকোষের শুক্রাণু কমে ৩৫ বছর বয়সে যা হত, সেটা হয়ে যাবে।”

ভারত থেকে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও এখনও এদেশেই ধূমপান বেশি হয় বলে মনে করছেন গৌতম খাস্তগীর।

ধূমপান ছাড়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “প্রয়োজনে সবচেয়ে প্রিয়জনের একটা ছবি মানিব্যাগে রাখবেন। ধূমপান করতে মন চাইলে ছবিটা বের করে ভাবুন, আপনি চলে গেলে তার কী হবে?

“আর যে সব পুরুষের সন্তান আসছে না, তারা স্ত্রীর ছবিটা রাখতে পারেন। ধূমপান সত্যি সত্যিই পারিবারিক জীবনকে শেষ করে দেয়। এটা মানুষকে মারা ছাড়াও জীবনটাকে ধ্বংস করে দেয়।”

বাংলাদেশ-ভারতসহ বিশ্বজুড়ে সন্তান না হওয়ার জন্য মুখ্যত নারীদের দায়ী করার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “কিন্তু বিষয়টা পুরোটাই ভিন্ন।

“সারা পৃথিবীতে বন্ধ্যাত্বের সমস্যার ক্ষেত্রে মেয়েদের দিকে আঙুল তোলা হয়। কারণ মেয়েরা সন্তান ধারণ করে। আগে বলা হতো, বন্ধ্যাত্বের এক তৃতীয়াংশ নারীদের সমস্যা, এক তৃতীয়াংশ পুরুষের সমস্যা, আর এক তৃতীয়াংশ উভয়ের সমস্যা বা কার সমস্যা সেটা জানা যায়নি।

“কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, শতকরা ৬০ শতাংশের ক্ষেত্রে সমস্যাটা পুরুষের। কথাটা শুনলে হয়তো একটু আশ্চর্য লাগবে। কিন্তু এটাই সত্যি।

“এখন দৈনন্দিন কাজ এত বেড়ে গেছে, চাপ, টেনশন এত বেড়ে গেছে, দূষণ-এই সব নিয়ে পুরুষদের শারীরিক অক্ষমতা বেশি ধরা পড়ছে। তাদের শুক্রকীটে বিভিন্ন সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে গৌতম খাস্তগীর বলেন, মোবাইল রেডিয়েশনের কারণে পুরুষের বন্ধ্যাত্ব বাড়ছে। তবে এটা মোবাইল কোথায় রাখছেন, সেটার উপর নির্ভর করছে।

তিনি বলেন, “এমনিতে শরীরের তাপমাত্রার চেয়ে অন্ডকোষের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম হওয়া উচিত। এটাই একমাত্র অঙ্গ যেটা শরীরের বাইরে রয়েছে। এটি থলিতে করে শরীরের বাইরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে তাপমাত্রা কম থাকে।

“যারা খুব টাইট প্যান্ট পরেন, অধিক তাপমাত্রায় কাজ করেন, অনেকক্ষণ মোটরসাইকেল চালান, কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে কাজ করেন, তাদেরও বন্ধ্যাত্বের সমস্যা হতে পারে।”

এই ঝুঁকি এড়াতে মোবাইল ফোন বুক পকেটে বা ব্যাগে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

“আমাদের দেশে গরমকালে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেই। যে পুরুষের শুক্রাণু কম, তাদেরকে বলি, একটা ছোট তোয়ালে সঙ্গে রাখবেন, দিনে তিন চারবার অন্ডকোষ ভালো করে ধুবেন।”

বন্ধ্যাত্ব বা সন্তান না হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রধান কারণ হলো শুক্রাণুর অনুপস্থিতি বা অস্বাভাবিকতা। দ্বিতীয়ত, ডিম্বানু বের না হওয়া বা অস্বাভাবিকভাবে ডিম্বানু বের হওয়া; কোনো মাসে বের হলো, কোনো মাসে বের হলো না। ঠিক সময়ে হলো না। কখনো কখনো ডিম্বনালীতে অবরোধ হয়।

“এছাড়া একটা অসুখ আছে, যাতে মেয়েদের ঋতুচক্রের একটা অংশ পেটে গিয়ে জমা হয়ে ডেলার মতো তৈরি করে। তাছাড়া জরায়ুর মধ্যে গঠনগত ত্রুটি থাকতে পারে। পলিট বা টিউমার থাকতে পারে।

“আগেরকার দিনে ভাবতাম, যক্ষ্মা কেবল বুকে শ্বাসনালীতে হয়। কিন্তু এখন আমরা জানি, হাড়েও যক্ষ্মা সংক্রমণ হতে পারে। জনন অঙ্গেও হতে পারে।”

“বন্ধ্যাত্বের জন্য কেউ আসলে আমাদের এখন নিয়ম হচ্ছে, প্রথম পুরুষের চিকিৎসা করতে হবে। এই রকম বহু রোগী আমরা পেয়েছি, যারা ৫-৭ বছর স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু স্বামী বেচারা যাননি। বরং তিনি স্ত্রীকে বলেছেন, আমি গিয়ে কী করবো, এটাতো তোমার সমস্যা। পরে দেখা গেছে, সমস্যাটা স্বামীর।”

বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা নিয়ে এই প্রজনন বিশেষজ্ঞ বলেন, “স্বামীর চিকিৎসাটা অনেক সোজা। স্বামীকে যদি আমরা একটু বীর্যদান করতে বলি, সেটা রক্ত দেওয়ার চেয়েও সোজা। তিন-পাঁচ দিন শারীরিক সম্পর্ক বন্ধ রেখে দেওয়া বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা, গতিশীলতার হার, দেখতে কেমন, সংক্রমণ রয়েছে কি না ইত্যাদি দেখতে হয়। তাদের কিছু হরমোন পরীক্ষা করতে হয়।

“স্ত্রীর ক্ষেত্রে হরমোন পরীক্ষা করতে হয়। রুবেলার টিকা নিতে হয়। রুবেলা বোঝা যায় না। সর্দি কাশির মতো। পরে দেখা যায়, বিকলাঙ্গ সন্তান হয়েছে।

“সন্তান নিতে আগ্রহী কোনো নারী আমাদের কাছে আসলে তিনি যদি গর্ভবতী না হন, তাহলে প্রথমে তাকে রুবেলার টিকা দিয়ে দেই। তার শরীরে ইনফেকশন না থাকলে দিতে হয়। ঋতুচক্রের প্রথম সপ্তাহে এটা নিতে হয় এবং এক মাস জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়, যাতে উনি সেই সময়ে গর্ভধারণ না করেন।

“হেপাটাইটিস, এইচআইভি, ব্যাকটেরিয়া, সিফিলিস, গনোরিয়া ইনফেকশন হয়। এই সব ইনফেকশনে স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনের থেকে আক্রান্ত হন। এতে জননাঙ্গে নানা সমস্যা দেখা দেয়।”

মেয়েদের ৩৫ বছরের আগেই সন্তান নেওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, এরপরেও সন্তান নেওয়া যায়। তবে তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম।

গৌতম খাস্তগীর বলেন, “চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাধারণ হিসাবে ৫০ বছর পর্যন্ত সন্তান নেওয়ার কথা বললেও পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রায় ২৫ জন নারী আমাদের চিকিৎসায় সন্তান পেয়েছে। আমরাই এর একমাত্র চিকিৎসা করি না। অনেকেই আছে। আপনাকে সঠিক পদ্ধতি জানতে হবে। চিকিৎসা করতে হবে।”

২০১৪ সালে গৌতম খাস্তগীরের তত্ত্বাবধানে এক নারী ৫৯ বছর বয়সে মা হয়েছিলেন, যার খবর সেই সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়।

গৌতম খাস্তগীরের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। তার পূর্ব পুরুষ চট্টগ্রামের ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা অন্নদাচরণ খাস্তগীর ১৮৭৮ সালে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যার বর্তমান নাম ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, লেখক মৈত্রেয়ী দেবী এই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন।