থমথমে বগুড়ার হরিপুর, হতভম্ব মানুষ

বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুরে শিয়া মসজিদে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে হতাহত হওয়ার ঘটনায় এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

জিয়া শাহীন বগুড়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2015, 09:59 AM
Updated : 27 Nov 2015, 09:59 AM

প্রায় তিন দশক ধরে এই এলাকায় সুন্নী ও শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসীরা একসঙ্গে বাস করছে; কখনো ধর্মীয় কোনো বিষয় নিয়ে বিতণ্ডা হয়নি। হঠাৎ মসজিদে নামাজের সময় এধরণের হামলায় হতভম্ব হয়ে পড়েছেন উভয় সম্প্রদায়ের মুসলিমরা।

এলাকার আতঙ্কিত মানুষরা ভেবে পাচ্ছেন না- কি কারণে গুলি করে নামাজরত মানুষকে হত্যা  করা হল।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, বৃহস্পতিবার মাগরিবের সময় কিচক ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের আল মোস্তফা মসজিদে অজ্ঞাত তিন বন্দুকধারী হামলা চালায়। বন্দুকের গুলিতে নিহত হন ওই মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন (৭০)। আহত হন ইমাম শাহিনুর রহমান (৬০) এবং স্থানীয় বাসিন্দা দুই মুসল্লি তাহের মিস্ত্রি (৫০) ও আফতাব আলী (৪০)।

আল মোস্তফা মসজিদের পশ্চিম দিকে জনবসতিশূন্য ফাঁকা মাঠ; অদূরেই পরিত্যক্ত একটি ইটভাটা। উত্তর দিকে কিছুটা দূরে বগুড়া-জয়পুরহাট সড়ক। মসজিদের দক্ষিণ দিক দিয়ে একটি পাকা রাস্তা চলে গেছে। দু’পাশেই শিয়া-সুন্নি মতাদর্শের লোকের বসবাস।

শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, ভোর থেকেই এলাকার লোকজন আল মোস্তফা মসজিদে ভিড় জমায়। ভেতরে চোখে পড়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ; আর মসজিদের পিলারের গায়ে গুলির দাগও স্পষ্ট।

আতঙ্কের কারণে সকালে এই মসজিদে ফজরের নামাজ পড়তে মাত্র ২/৩ জন এসেছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

চারিদিকে পুলিশ-র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অবস্থান নিয়েছে। আশ-পাশের লোকজনের ভাষা যেন থেমে গেছে; ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতবাক হয়ে পড়েছে।

হরিপুরের এই মসজিদকেন্দ্রীক শিয়াদের একটি সংগঠন রয়েছে; বাংলাদেশ ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন নামে। এর চেয়ারপারসন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর ও সেক্রেটারি জেনারেল মো. মোজাফ্ফর হোসেন।

মোজাফ্ফর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এলাকায় শিয়া-সুন্নি কোনো দ্বন্দ নেই। শিয়া সম্প্রদায় মসজিদটি নির্মাণ করলেও ওই মসজিদে উভয় মতাদর্শের মানুষরা নামাজ আদায় করেন; কখনও কোনো বিরোধ দেখা দেয়নি।

“হঠাৎ গুলির ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। নিহত মোয়াজিন খুব সাধারণ মানুষ ছিলেন; কখনও কারো সঙ্গে তার বিরোধ হয়নি।”

তিনি ইরানের আল মোস্তফা ইউনিভারসিটিতে কোরআনিক সায়েন্স বিভাগে আট বছর পড়াশুনা করছেন বলে জানান তিনি।

ফাউন্ডেশনের প্রধান আবু জাফর জানান, ১৯৮২ সালে ঢাকায় ইরানি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এলাকায় তিনিই প্রথম শিয়া মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। পরে এলাকায় ‘ইসলামিয়া স্টাডি সার্কেল’ নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। ওই পাঠাগারের মাধ্যমে পরে এলাকার আরও অনেকে শিয়া মতাদর্শ গ্রহণ করেন। এই মসজিদ কেন্দ্র করে ১১০ জন শিয়া মতাদর্শী রয়েছে।

কিচক ইউনিয়নের হরিপুর, চল্লিশছত্র, আলাদিপুর, গোপিনাথপুর, রামকান্দি ও বেলাইল গ্রামে শিয়াদের বাস। এই আল মোস্তফা মসজিদে তারা নামাজ আদায় করে।  এছাড়া পাশের গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পানিতলা, কানদিয়া, বড়িপাড়া ও খড়পা এলাকায়ও শিয়াদের বসবাস রয়েছে; তারা জিয়ারতের সময় এখানে আসে।

হরিপুরের শিয়া মতাবলম্বী আব্দুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার আপন জ্যাঠাতো ভাই ইদ্রিস আলী সুন্নি আর আমি শিয়া; আমাদের পাশাপাশি ঘর। কখনও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে বাক-বিতণ্ড হয় না; আমরা মিলে মিশে থাকি। এমনিভাবেই অন্য শিয়া-সুন্নিরাও মিলে মিশে থাকে।

ওই এলাকার সুন্নি মুসলিম হায়দার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এলাকায় শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে কখনও দ্বন্দ-বিবাদ ছিল না। ওই মসজিদে দুই মতাদর্শের মানুষই নামাজ পড়ত। আমাদের মধ্যে খুবই সম্পর্ক ভাল।”

কিন্তু তার পরও মসজিদের মধ্যে হামলার ঘটনায় উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ হতভম্ব ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

শিয়া নেতা জাফর বলেন, “গুলির ঘটনায় আমরা হতভম্ব হয়ে পড়েছি। আমরা কাউকে আঘাত করি না। কেন এমনটি হল? আতঙ্কে রয়েছি।”

তবে মাঝে মাঝেই এই এলাকায় বিভিন্ন ইসলামী জলসায় বাইরে থেকে আসা বক্তারা ‘শিয়ারা কাফের’ বলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে জানান তিনি।

“বছরখানেক আগে শিবগঞ্জ উপজেলার আলীয়ারহাট এলাকায় এক জলসায় বগুড়া শহরের কাটনার পাড়া কুবা মসজিদের ইমাম মাওলানা আশরাফ আলী সিদ্দিকী এই ধরনের বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি আশপাশের অনেক এলাকার জলসায়ও যান।”

বৃহস্পতিবার আল মোস্তফা মসজিদে গুলির ঘটনার পেছনে ওই সব উসকানিমূলক বক্তব্য রসদ যুগিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

বগুড়া পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, “যারা শিয়া বিদ্বেষী তারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে। তারপরেও এ বিষয়টির পাশাপাশি অন্যান্য বিষয় মাথায় রেখে আমরা তদন্ত করে দেখছি।

“সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনার পর দেখা যায়, আইএস দায় স্বীকার করে।  কিন্তু প্রতিটি ঘটনায় যা উদ্ঘাটিত হয়েছে, তার সাথে আইএসের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ ঘটনায় আইএসের দায় স্বীকার করার কোনো ভিত্তি খুঁজে পাই না।”

শিবগঞ্জ থানার ওসি আহসান হাবিব জানান, গুলির ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শুক্রবার ভোরে আনোয়ার হোসেন ও জুয়েল নামে দুজনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়ার ঘটনাস্থল থেকে আটটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতেই মসজিদের কোষাধ্যক্ষ সোনা মিয়া বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছে।

নিরাপত্তার জন্য ঘটনাস্থলে পুলিশ-র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মোতায়েন রয়েছে বলে জানান ওসি আহসান।

বৃহস্পতিবার মাগরিবের নামাজের সময় মসজিদের ভেতরে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের গুলিতে ইমাম শাহীনুর রহমান, মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন, মুসল্লি আবু তাহের ও আফতাব উদ্দিন আহত হন।

তাদের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মোয়াজ্জেম হোসেন মারা যান।

এঘটনায়ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ‘দায় স্বীকার’ করেছে বলে খবর দিয়েছে ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’।