এমপি লিটনের জামিন নাকচ, আত্মসমর্পণের নির্দেশ

এক শিশুর পায়ে গুলি করার অভিযোগে গাইবান্ধার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের আগাম জামিনের আবেদন খারিজ করেছে হাই কোর্ট।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2015, 08:15 AM
Updated : 12 Oct 2015, 01:52 PM

আগামী ১৮ অক্টোবরের মধ্যে তাকে গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এমপি লিটনের জামিন আবেদনের ওপর শুনানি করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর অবকাশকালীন বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেয়।

আদেশে বলা হয়, আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নিয়ে এবং মামলার এজাহার পর্যালোচনায় ‘আগাম জামিনের কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি’। তাই আবেদন খারিজ করা হল।

সোমবার সকালে লিটনের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোকছেদুল ইসলাম আগাম জামিনের আবেদন বেঞ্চে উপস্থাপন করলে আদালত বেলা ১টায় আবেদনকারীকে শুনানিতে হাজির করতে বলে।

সে অনুযায়ী মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন আদালতে এলে সোয়া ১টায় শুনানি শুরু হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ১টা ৫০ মিনিটের দিকে আদালত আদেশ দেয়।

পুরো সময় সাদা শার্ট ও ধুসর প্যান্ট পরা লিটন আদালতকক্ষে দাঁড়িয়েই ছিলেন।

শুনানিতে লিটনের পক্ষে অংশ নেন মোকছেদুল ইসলাম; সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এস এম আরিফুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম; সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল এ কে এম জহিরুল হক, বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও একরামুল হক টুটুল।

আবেদন দাখিলের সময় শুনানিতে লিটনের আইনজীবী মোকছেদুল ইসলাম আদালতকে বলেন, “দুঃখজনক, একটি শিশু আহত হয়েছে ও মামলা হয়েছে।”

আদালত বলে, “অভিযোগে দেখা যাচ্ছে, শুধু গুলিই করেনি, হাসপাতালে নিতে বাধাও দিয়েছেন।”

ব্যারিস্টার মোকছেদুল বলেন, অভিযোগে হত্যার উদ্দেশ্য হাতে লেখা হয়েছে। উনি একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

“ফ্যাক্ট দেখা প্রয়োজন। অত ভোরে একটি বাচ্চা দাঁড়িয়ে ছিল, এটা কি হতে পারে? ডাকল, শুনল না, গুলি করে দিল? এত ভোরে বাচ্চা কোত্থেকে এল?”

আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলে, “সকাল বেলা আপনিও তো বেরিয়েছেন?”

জবাবে মোকছেদুল বলেন, “আমি (আসামির প্রতিনিধিত্বকারী) জনপ্রতিনিধি, জনগণের কাছে রাতে-দিনে বের হতে হয়।”

আদালত বলে, “আগাম জামিনের বিষয়ে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত আছে। এর বাইরে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। এর বাইরে কিছু থাকলে দেখান।”

মোকছেদুল বলেন, “আমার পিছনে লোক লেগেছে। এরপরও আরেকটি মামলা হয়েছে। এখন ওখানে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে জামিন চাইছি।”

আদালত বলে, “জনপ্রতিনিধি হলে তো পক্ষে-বিপক্ষে লোক থাকবে। আপনাকে আইন অনুযায়ী চলতে হবে।”

মোকছেদুল ইসলাম বলেন, “আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই আদালতে এসেছি। এখন ওখানে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই। তাই আত্মসমর্পণের জন্য সুযোগ চাইছি।”

শুনানিতে অংশ নিয়ে অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম মামলার এফআইআর তুলে ধরে বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ২ অক্টোবর সৌরভ ব্যয়াম করতে যায়। লিটন তাকে ডাকে, সৌরভ শুনে নাই। বাদীর ছেলেকে হত্যার উদ্দেশ্যে তিনটি গুলি ছোড়ে।”

জামিনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “তিনি জনপ্রতিনিধি, এটা কি তার কার্যক্রম হতে পারে? সাধারণ লোক আর প্রতিনিধির করা অপরাধের মধ্যে প্রতিনিধির অপরাধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি ওই অপরাধের বিরোধিতা করে কোনো বিবৃতিও দেয়নি।”

এরপর আগাম জামিন নিয়ে আপিল বিভাগের কয়েকটি মামলার রায় ও সিদ্ধান্ত তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “সোসাইটির কথা চিন্তা করতে হবে। যদি জামিন পেয়ে যান তাহলে সমাজে কী মেসেজ যাবে? যে যত ক্ষমতাশীল, আদালত হবে তার জন্য তত শক্ত, আইন হবে তত কঠোর।”

এখান থেকে পুলিশ ডেকে তাকে (লিটন) কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার আরজি জানিয়ে অ্যার্টনি জেনারেল বলেন, “আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুসারে হয় জামিন দিতে হয়, নতুবা তাকে পুলিশে হস্তান্তর করতে হয়।”

এ সময় লিটনের আইনজীবী আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়ার আরজি জানিয়ে বলেন, “মিডিয়া ট্রায়ালের সম্মুখীন হচ্ছি, যেভাবে পুরো জিনিসটাকে সেনসেটাইজ করা হচ্ছে।”

আদালত বলেন, “আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত রয়েছে। উপযুক্ত আদালতে গিয়ে হাজির হন। হাজির হতে সমস্যা কী?”

এরপর আগামী ১৮ অক্টোবরের মধ্যে তাকে গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করতে আদেশ দেয় আদালত।

আদেশের পর মোকছেদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুই মামলায় আদালত একই নির্দেশ দিয়েছেন। এর ফলে এই সময়ের মধ্যে (১৮ অক্টোবর) লিটনকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ নেই।

“কেননা গ্রেপ্তার করা হলে তিনি হাই কোর্টের নির্দেশনা অনুসারে তিনি নিম্ন আদালতে যেতে পারবেন না। উনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নির্ধারিত সময়ে নিম্ন আদালতে আত্নসমর্পণ করবেন।”

এদিকে নিজ কার্যালয়ে অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, লিটনের জামিন আবেদন নাকচ হলেও আদালতের নির্দেশনা ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়’।

হাই কোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত চেয়ে লিটনকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তারের জন্য মঙ্গলবার চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করবেন বলে তিনি জানান।

“আদালত বলল, ১৮ তারিখের ভেতর আত্মসমর্পণ করতে। পুলিশের প্রতি নির্দেশনা নেই গ্রেপ্তার না করার ব্যাপারে। তবুও পুলিশ প্রশাসন দ্বিধাগ্রস্ত থাকবে- এজন্যই আমি সুপ্রিম কোর্টে যাব।”

‘মিডিয়া ট্রায়াল’ হচ্ছে বলে শুনানিতে তোলা আসামিপক্ষের আইনজীবীর দাবির বিষয়ে হলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, একজন জনপ্রতিনিধির দ্বারা কোনও ঘটনা ঘটলে মিডিয়া নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। খবর হওয়া মানেই গণতন্ত্রের বিকাশ হওয়া। খবর চেপে থাকা মানে গণতন্ত্র না থাকা।

“কাজেই আমাদের মিডিয়াগুলো এ ব্যাপারে যে খবর দিচ্ছে, সেটা গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তি হিসেবেই দিয়েছে তারা।”

আদেশের পর আইনজীবীর চেম্বারে সাংবাদিকরা সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের কাছে পলাতক থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার দুটি অস্ত্র জমা নিয়ে নিয়েছে। আমার নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে, কারণ এলাকাটি জামায়াত অধ্যুষিত। ওখানে চার জন পুলিশকে মেরেছে। যার জন্য আমি একটু নিরাপদে ছিলাম, যাতে জামায়াত হামলা করতে না পারে।”

আত্মসমর্পণ করবেন কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “কোর্টের আইন তো মানতেই হবে।”

গত ২ অক্টোবর গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য লিটনের ছোড়া গুলিতে শাহাদাত হোসেন সৌরভ নামে নয় বছর বয়সী ওই শিশু আহত হয় বলে পরিবারের অভিযোগ।

আহত শিশুর বাবা সাজু মিয়া ঘটনার পরদিন সাংসদ লিটনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া ভাংচুর ও লুটপাটের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন হাফিজার রহমান নামে সর্বানন্দ ইউনিয়নের উত্তর শাহাবাজ গ্রামের এক বাসিন্দা।

এদিকে গুলির ঘটনার পর থেকেই আত্মগোপনে চলে যান সাংসদ লিটন। তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার না করায় গাইবান্ধায় নানা কর্মসূচিও পালিত হয়।

ওই ঘটনায় সমালোচনার মধ্যে লিটনের লাইসেন্স করা দুটি অস্ত্র সুন্দরগঞ্জ থানায় জমা দেন তার স্ত্রীর বড় ভাই তারিকুল ইসলাম। এরপর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লিটনের অস্ত্র দুটির লাইসেন্স বাতিল করেন।

এই সংসদ সদস্য এর আগেও নানা ‘অপকর্ম’ করেছেন বলে তার দলের নেতাদের অভিযোগ। স্থানীয়রা তার সাংসদ পদ বাতিলেরও দাবি তুলেছেন।