দক্ষিণ এশিয়ায় সংবাদের জন্য আরও ব্যয় করার আহ্বান

সবার জন্য প্রবৃদ্ধি অর্জনের বাধা সরানোসহ দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা সমাধানের চাবি যে রাজনীতিকদের হাতে, গণমাধ্যম শুধু প্রশ্নের মুখোমুখি রেখে তাদের দায়িত্বশীল রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে।

নয়া দিল্লি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2015, 01:03 PM
Updated : 6 Oct 2015, 11:45 AM

ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে গুরুত্বপূর্ণ এক আঞ্চলিক সম্মেলনে একথা বলেছেন গণমাধ্যমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা।

অন্তত দুজন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক সমস্যা সমাধানে সহযোগিতার পরিবর্তে উল্টো ঝামেলা বাঁধানোর জন্য গণমাধ্যমকে দুষেছেন।

৯৫ হাজার সংবাদপত্র নিয়ে শক্তিশালী ভারতের গণমাধ্যম শিল্পও আঞ্চলিক প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার ‘মিডিয়া গ্রুপ’গুলোর এখন এই অঞ্চলের সংবাদ সংগ্রহে আরও বেশি বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক কনক্লেভের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার একটি প্ল্যানারি সেশনে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার জন্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনায় এই প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেন তিনি।

এই পর্বের অন্য আলোচকরাও বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো ভারতের সংবাদ যতোটা আগ্রহভরে দেয়, ভারত অন্যদের সংবাদ পরিবেশনে ততোটাই অনাগ্রহী।

এই সমালোচনা স্বীকার করে নিয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার কূটনৈতিক সম্পাদক ইন্দ্রানি বাগচি বলেন, “ভারত নিজের মধ্যে মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছে।”

“এর পরিবর্তন দরকার, যদি আমরা এই অঞ্চলের মানুষকে আরও কাছাকাছি আনতে গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা চাই,” বলেন তৌফিক খালিদী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক ভারতে তার প্রতিষ্ঠানের ছয়জন সাংবাদিক থাকার কথা তুলে ধরেন, সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের প্রচ্ছদ পাতায় প্রতিবেশী দেশগুলোর সংবাদ পরিবেশনে সুনির্দিষ্ট স্থান রাখার বিষয়টিও বলেন।

“দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতীয় বড় বড় সংবাদ মাধ্যমেরও বাংলাদেশে একজন পূর্ণকালীন প্রতিনিধি পর্যন্ত নেই,” বলেন তিনি।

আলোচনায় আফগানিস্তানের টলোনিউজ টিভির পরিচালক লুৎফুল্লাহ নাজাফিজাদা এবং নেপালের সাময়িকী হিমাল সাউথ এশিয়ানের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কনক মনি দিক্ষিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রধান সম্পাদককে সমর্থন জানান।

পাকিস্তানের নাজাম শেঠি ও আমিন হাসওয়ান এবং ভুটানের অশোক তিরওয়াও এই পর্বে বক্তব্য রাখেন। এই অঞ্চলে সামনে এগোনোর এজেন্ডাগুলোকে গতিশীল করতে গণমাধ্যম কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করেন তারা।

পাকিস্তানের জনপ্রিয় সাংবাদিক ফ্রাইডে টাইমসের সম্পাদক শেঠী গণমাধ্যমের সমালোচনা করতে গিয়ে কাশ্মির সমস্যার উদাহরণ দেন।  

তার মতে, গণমাধ্যম এই সমস্যা সমাধানে সহায়তার পরিবর্তে জিইয়ে রাখতেই বেশি ভূমিকা রাখছে।

নেপালের কনক মনি দিক্ষিত বলেন, এই অঞ্চলের সাংবাদিকদের মাত্রাতিরিক্ত স্বজাত্যবোধ অনেক সময় পরিস্থিতি জটিল করে দেয়।

সবার জন্য প্রবৃদ্ধি অর্জনের আহ্বান নিয়ে আয়োজিত তিন দিনের এই সম্মেলনে এই অর্জনের ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরেন গণমাধ্যমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা।

আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যদিও সার্ক দেশগুলোতে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করছে, তবে বড় পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক বিবেচনা এই মুক্ত চলার পথে বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

আলোচনায় তৌফিক খালিদীর কাছে এই প্রশ্নও আসে, কীভাবে গণমাধ্যম ‘গঠনমূলক’ ভূমিকা রাখতে পারে। এবং কীভাবে আন্তঃদেশীয় বিষয়গুলোতে আরও গ্রহণযোগ্য সংবাদ পরিবেশন করা যায়, যেখানে প্রায়ই গঠনমূলক সংবাদের পরিবর্তে উত্তেজক খবর পরিবেশন দেখা যায়।

তিনি বলেন, “প্রথমে বলতে হয়, কোনটিকে গঠনমূলক বলবেন? আর উত্তেজকই বা কোনটি? এই সীমারেখা কীভাবে টানবেন? এক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা কি আছে?

“আমরা ফেলানীর (বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি কিশোরী) খবর দেব, এটা আমার জন্য সংবাদ। আবার আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে এটা উত্তেজনা সৃষ্টিকারী মনে হতে পারে।

“ধরুন, আমি এনিয়ে কথা বলা বন্ধ করলাম। কিন্তু অনেকেই আছেন, যারা এতে শিরোনাম হওয়ার মতো খবর দেখতে থাকবেন। তখন তারা আবার ওই ছবি পুনরায় দেখাবেন, আবার আসবে খবর। তা হয়ত আপনাদের পছন্দ হবে না।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রধান সম্পাদক বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা বিভক্ত জাতি। রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে আমরা নিদারুণ মেরুকরণের মধ্যে আছি। আমার সাংবাদিক বন্ধুদের অনেকেই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী এবং তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না।

“ভারতকে চাপিয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে তোলাই যদি দলের নীতি হয়, তাহলে তারাও তাই করবেন। এরকম ঘটনা অনেক, ফলে দুর্বল শিরোনাম হয়। তা শুধু অপসাংবাদিকতাই নয়, বিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িক উসকানিও ছড়ায়।”

‘ইতিবাচক নির্দেশনা’ দিতে ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যম কীভাবে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে পারে সে প্রশ্নের জবাবে তৌফিক খালিদী বলেন, এটা রাজনীতিবিদদের করতে হবে। গণমাধ্যম শুধু সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

“আমরা সমালোচনা করতে পারি, পারি ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে, নীতিগত ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলতে পারি আমরা; আর তা থেকে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসতে পারে, ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক।

“মূল কথা হচ্ছে, পেশাদারিত্বের বিকল্প নেই। সংবাদকে একটি পণ্য হিসেবে নিলে এর গুণের প্রশ্নে আপসের সুযোগ নেই। এটা আমাদের মানতেই হবে যে, খারাপ সংবাদই সবচেয়ে বড় খবর,’ বলেন তৌফিক খালিদী।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ভারত সরকারের সহায়তায় সিআইআই আয়োজিত এই কনক্লেভ একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আমার রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছ থেকে যা শুনছি, তা খুব উৎসাহব্যঞ্জক নয়।

“তারা আমাকে বলেছে, ভারতসহ অন্যদের কাছ থেকে কোনও ফল বের করা কঠিন। তাই এর পরিবর্তনটা দরকার।

“এটাকে অবশ্যই আরেকটা কথার দোকান করা যাবে না,” প্রতি বছর এই সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন খালিদী।