সব প্রেরণার উৎস যেন ধানমণ্ডির ওই বাড়ি: হাসিনা

এক রাতে ঘাতকের বুলেটে যে বাড়িতে প্রাণ হারিয়েছিলেন বাবা-মাসহ অধিকাংশ স্বজন, যে বাড়িতে ছড়িয়ে আছে প্রিয়জনদের স্মৃতি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সেই বাড়িই যেন সব অনুপ্রেরণার উৎস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Sept 2015, 03:53 PM
Updated : 2 Sept 2015, 04:00 PM

বুধবার জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার সকল ব্যথা-বেদনা সহ্য করার শক্তি আর বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসিয়ে ফুটিয়ে তোলার জন্য কাজ করার, প্রেরণা সঞ্চয় করার জায়গা যেন এটা। এই বাড়ি থেকেই যেন শক্তি পাই।

“একদিকে সব হারানোর বেদনা অন্যদিকে মানুষের সেবা করার প্রেরণা- সবই এখানে এলে পেয়ে থাকি।”

সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পীর প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা একথা বলেন।

প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুতেই নিজের প্রশ্নটি শুধু উত্থাপন করেন বাপ্পী।

প্রধানমন্ত্রী তার উত্তর দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে বলেন, পুরো প্রশ্ন না পড়লে, উত্তর বোঝা যাবে না।

এরপর শেখ হাসিনাই বাপ্পীর উত্থাপিত প্রশ্নটি পড়েন।

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুগ্রহ করিয়া বলিবেন কি, ’৭৫ এর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় আপনি ও আপনার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বাঁচিয়া যান ইহা সত্য কি না; ঐ নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে আপনাকে দেশে আসিতে দেওয়া হয় নাই। কবে এবং কোন পরিস্থিতিতে আপনি দেশে প্রত্যাবর্তন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন; ইহা আরো সত্য কি না যে, জিয়াউর রহমান আপনাকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে প্রবেশ করিতে দেয় নাই; সেই বেদনা বিঁধুর অনুভূতির কথা বলিবেন কি না?”

জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই আমি ও রেহানা জার্মানি যাই। ১৫ দিনের মাথায় হঠাৎ শুনি আমরা দুই বোন এতিম হয়ে গেছি। নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে গেছি।

“খুনি মোশতাক ও তার দোসর জিয়াউর রহমান ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ড চালায়। বাংলাদেশে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পালা শুরু হয়। জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দেয়।”

ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশে ফিরতে চাইলে তাদের বাধা দেওয়া হয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “রেহানার পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে সময় বর্ধিত করতে লন্ডন হাই কমিশনে পাঠানো হয়, জিয়াউর রহমানের নির্দেশে তা বর্ধিত করা হয় নাই। তাকে পাসপোর্টও দেওয়া হয় নাই।”

তার অবর্তমানে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হলে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “জিয়াউর রহমান আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে সফল হতে পারে নাই। বাংলাদেশের জনগণ ও আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মী বাহিনী সকল বাধা উপেক্ষা করে আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন।”

দেশে ফেরার পর ওই বছর ১২ জুন পর্যন্ত তাকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ওই বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, যেখানে নিহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যরা।

শেখ হাসিনা বলেন, “পিতা-মাতা, ভাইদের জন্য একটু দোয়া করার সুযোগও ‍আমাকে দেওয়া হয়নি। পুলিশ পাহারা ও গেইটে তালা দিয়ে ‍আমার পথ রুদ্ধ করা হয়। আমি রাস্তার উপরই বসে পড়ি এবং আমাদের নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলাদ ও দোয়া পড়ি।

“জিয়াউর রহমান ধানমন্ডির বাড়ি ও ৩২ নম্বর সড়কের নম্বরও বদলে দেয়। প্রতি রাতে কার্ফ্যু জারি করে রাখে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালের ১২ জুন হঠাৎ করে এক ঘণ্টার নোটিশে বাড়িটি আমাকে হস্তান্তর করে।

“ধূলি ধূসর, বিধ্বস্ত, রক্তের ছোপ ছোপ কালো দাগ ও রক্তমাখা ছড়ানো ছিটানো কাপড় চোপড়, ছেড়া বালিশ, রক্তমাখা তুলা দেওয়ালের গায়ে ও মেঝেতে গুলির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে গিয়ে আমি জ্ঞান হারাই।”

স্বজনরা খুন হওয়ার পর ওই বাড়িতে প্রথম ঢোকার স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে শেখ হাসিনার কণ্ঠ।

থেমে থেমে তিনি বলেন, “যখনই আমি সিঁড়ির ধাপের মাঝামাঝি উঠে আসি তখনই আমার নজরে পড়ে সিঁড়ির সেই অংশটি, যেখানে ঘাতকের আঘাতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন আমার বাবা। আমি সহ্য করতে পারিনি। ছুটে ফিরে নিচে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু বের হতে পারিনি। নীচ তলার কলাপসিবল গেইট বন্ধ থাকার কারণে আমি বের হতে পারিনি। ‘দরজা খোল’ বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে দেখি আমি তিন তলার ছাদে।”

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট রাতে একদল সেনা সদস্যের হাতে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় নিহত হন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ওই বাড়িটি এখন বঙ্গবন্ধু ভবন নামে পরিচিত, সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর।